Dr Khondaker Golam Moazzem on market diversification

Published in Samakal on Saturday, 1 February 2014.

বাজার বহুমুখী করতে হবে
বাণিজ্যের
ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা পোশাক খাতের ইমেজ পুনরুদ্ধার বাজার নিয়ন্ত্রণ

জাকির হোসেন

তৈরি পোশাক থেকে আসে রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ। আবার ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে আসছে মোট রফতানি আয়ের ৭০ শতাংশ। এ বাস্তবতা আজকের নয়, অনেক বছরের। ধীরে ধীরে রফতানি তালিকায় কিছু নতুন পণ্য যোগ হলেও তা তেমন বিকশিত হতে পারেনি। রফতানি বাণিজ্যের এ দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যমূল্য সহনীয় রাখা নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর পোশাক খাতের ইমেজ পুনরুদ্ধার, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠাসহ আরও কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে বাণিজ্য খাত।

বিশ্লেষকদের মতে, সীমিত রফতানি পণ্য তালিকা ও সীমিত বাজার, অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশের প্রধান বাধা। তবে রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, প্রধান

রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকের প্রতি যেন গুরুত্ব না কমে যায়। তৈরি পোশাকের রফতানি বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি নতুন নতুন পণ্যের রফতানি বাড়ানো গেলে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন বাড়বে। অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও গতিশীল হবে। এর প্রভাবে দারিদ্র্য আরও কমবে; বাড়বে কর্মসংস্থান।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, বাংলাদেশের রফতানি আয় প্রতি বছর বাড়লেও সীমিত পণ্য ও বাজারের ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। হালকা প্রকৌশল, জাহাজ নির্মাণের মতো অনেক সম্ভাবনাময় শিল্প রয়েছে, যা ভবিষ্যতে রফতানি আয়ের অন্যতম বড় খাত হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। আর অভ্যন্তরীণ বাজার বৃদ্ধি ও পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তিনি বিশেষ মনোযোগ দেবেন। বাণিজ্য সচিব মাহবুব আহমেদ সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানি করতে পারে। এ কারণে ওই বাজারের প্রতি নির্ভরতা বেশি। এখন ইউরোপের বাইরে বেশ কিছু দেশে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া গেছে। এসব দেশে রফতানি বাড়ছে। সুতরাং বাজার বহুমুখীকরণ ধীরে হলেও এগোচ্ছে।

এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আনিসুল হকের মতে, তৈরি পোশাক এখন অনেক দেশেই রফতানি হচ্ছে। চীন ও জাপানের মতো কিছু বাজারে এখনও যাওয়ার অবকাশ আছে। তবে তৈরি পোশাকে মূল্য সংযোজন করে বিদ্যমান বাজারগুলোতেই রফতানি বাড়ানোর সুযোগ আছে। পণ্য বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে হালকা প্রকৌশল ও হস্তশিল্পজাত সামগ্রীর মতো কিছু খাতে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। জাহাজ রফতানিরও ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। এ সবের জন্য সরকারের নীতি-সহায়তা দরকার। নতুন সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী আগে থেকেই বাণিজ্যবান্ধব। বাণিজ্য সম্প্রসারণে তিনি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা ।

গবেষণা সংস্থা সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সমকালকে বলেন, সীমিত সংখ্যক রফতানি পণ্য থেকে বেরিয়ে আসার কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রা দরকার। তবে বিদ্যমান পণ্যে বৈচিত্র্য এনেও রফতানি আয় বড় অঙ্কে বাড়ানো যেতে পারে। যেমন_ তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে তুলা জাতীয় পণ্যই রফতানি করছে বাংলাদেশ। সিনথেটিকসহ তুলাবহির্ভূত পণ্যের বড় বাজার রয়েছে। তার মতে, বাংলাদেশ নানা অভ্যন্তরীণ ও বহিঃসংকটের মধ্যেও যে ভালো করছে, তার প্রধান কারণ কয়েকটি দেশে বিশেষ বাজার সুবিধা। এ বিবেচনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় বাজার সুবিধার চেষ্টা করতে হবে। খন্দকার মোয়াজ্জেম মনে করেন, বাণিজ্য আলোচনার মাধ্যমে কীভাবে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা পাওয়া যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক দেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির দিকে সাম্প্রতিক সময়ে বেশি মনোযোগী হয়েছে। বিশেষ করে ভারত এ বিষয়ে অনেক এগিয়েছে।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশের মোট রফতানি আয়ের ৪৭ শতাংশ আসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে। গত অর্থবছরের (২০১২-১৩) রফতানি আয়ে ইইউর অংশ দাঁড়ায় ৪৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ওই অংশ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫৪ শতাংশে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ২৮ শতাংশ রফতানি আয় ছিল। গত অর্থবছরে তা ছিল ২২ শতাংশ। সুতরাং এ দুই বাজারের ওপর নির্ভর করে আছে রফতানি খাত। এশিয়ার বাজারে রফতানির অংশ ওই সময়ের ব্যবধানে কিছুটা বেড়েছে; তবে সার্ক দেশগুলোতে বাড়েনি। কয়েক বছর ধরে তৈরি পোশাক খাত থেকে ৮০ শতাংশের মতো রফতানি আয় আসছে।

পোশাক খাত নিয়ে দুশ্চিন্তা :রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক পোশাক শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় সারাবিশ্বে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ইমেজ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশ কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার ওপর এ খাতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলেছে, তৈরি পোশাকশিল্পের ইমেজ পুনরুদ্ধার বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপি প্রত্যাহার করলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশ। আগামী জুনে বাংলাদেশের জিএসপি পর্যালোচনা করবে ইইউ। সুতরাং শ্রমিক অধিকার ও কারখানার নিরাপত্তা বিষয়ে বাংলাদেশের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির ঝুঁকি :পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, গত কয়েক মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। সর্বশেষ ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের বেশি। ভারতে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রবণতা রয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য শঙ্কার। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এ বিষয়ে সমকালকে বলেন, আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধি যাতে না ঘটে তার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সতর্ক দৃষ্টি থাকবে।

ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ :সিপিডির হিসাবে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় গত ছয় মাসে ৪৯ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ১৬ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকার ক্ষতি সড়ক পরিবহন খাতে। পাশাপাশি কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পে ১৫ হাজার ৮২৯ কোটি, রফতানিমুখী পোশাক ও বস্ত্র খাতে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি এবং পর্যটন খাতে ক্ষতি ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। সিপিডি বলেছে, পোশাক খাতের ক্ষতি পোষাতে সরকার কিছু সহায়তা ঘোষণা করেছে। অন্য খাতে বিশেষ করে কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্পে সরকারের সহায়তা দরকার। এসএমই খাতে টার্নওভার ট্যাক্স কমানোর বিষয়টি সরকার বিবেচনা করতে পারে।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সমকালকে বলেছেন, এ বিষয়ে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।