Published in Prothom Alo on Saturday, 13 December 2014.
৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানির চ্যালেঞ্জ
স্বপ্নের পথনকশার বাস্তবায়ন অজানা!
শুভংকর কর্মকার
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে শেষ করার কথা ছিল। তবে এখন পর্যন্ত অর্ধেক কাজ হয়েছে। এ জন্য দেশের রপ্তানিকারকদের পণ্য পরিবহনে কয়েক গুণ বেশি সময় ব্যয় হচ্ছে। নানা ধরনের জটিলতায় পড়ছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ধীরগতির জন্য এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট। আর এমন প্রেক্ষাপটেই পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের পোশাকের রপ্তানি হবে ৫০ বিলিয়ন বা পাঁচ হাজার কোটি ডলার। স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশবাসীকে এই উপহার দিতে চায় বিজিএমইএ। এই স্বপ্নের দোরগোড়ায় পৌঁছার পথনকশা খুঁজতে গত সপ্তাহে সাড়ে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা অ্যাপারেল সামিটের আয়োজন করে সংগঠনটি।
দেশের পোশাক রপ্তানির আয় গত অর্থবছরে ছিল দুই হাজার ৪৪৯ কোটি ডলার। ৫০ বিলিয়নে পৌঁছাতে হলে এটি দ্বিগুণ করতে হবে। হাতে সময় মাত্র ছয় বছর। বিজিএমইএর নেতাদের ভাষ্য, বর্তমান বিশ্বে পোশাকশিল্পের বাজার ৪৫ হাজার কোটি ডলারের। এখানে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র ৫ শতাংশ। আর মাত্র ৩ শতাংশ বাড়াতে পারলেই লক্ষ্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো যাবে।
অবশ্য এই রপ্তানি আয়ে পৌঁছাতে বাংলাদেশকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। অ্যাপারেল সামিটের আলোচনা-বিতর্কে এ বিষয়গুলো ভালোভাবেই উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, রপ্তানির পাশাপাশি আমদানিও সমান হারে বাড়বে। তখন চার লেন বদলে আট লেনের মহাসড়কের প্রয়োজন পড়েব। সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বর্তমানের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়াতে হবে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এ ক্ষেত্রে ভালো সমাধান। গ্যাস ও বিদ্যুতের প্রাপ্ততা নিশ্চিত করতে হবে। তবে উদ্যোক্তারা এখনই চাহিদামতো গ্যাস-বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পরিদর্শনে অনেক কারখানা সংস্কার ও স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কিন্তু কারখানার মালিকেরা স্বল্প সুদে ঋণ পাচ্ছেন না। কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করতে আগামী পাঁচ বছরে তিন থেকে চার বিলিয়ন ডলার লাগবে।
সামিটে অংশ নেওয়া দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও শিল্পের উদ্যোক্তারা ছয় বছরে পোশাক খাতের রপ্তানি ৫০ বিলিয়নে নিয়ে যেতে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি জোর দিয়েছেন কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নতিসহ শ্রমিকদের জীবনমান ও অধিকার নিশ্চিত করতে উদ্যোক্তাদের মানসিকতা পরিবর্তনের ওপর। বলেছেন, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, পণ্যের মানোন্নয়ন, উচ্চমূল্যের পণ্য তৈরিতে মনোযোগ বাড়ানো দরকার।
তিন দিনের সম্মেলনের বিভিন্ন সেমিনারে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। সরকারের এই নীতিনির্ধারকেরা এই আশাবাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তবে তাঁরা কেউই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা শোনাননি, কেবল আশ্বাসই দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ৭ থেকে ৯ ডিসেম্বর এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন বিষয়ে নয়টি সেমিনার হয়। বিজিএমইএর তিনজন সাবেক ও বর্তমান নেতা এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন, পোশাকের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার এই ধারণাটি নতুন। তা ছাড়া সম্মেলনে উঠে আসা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ এবং কী করণীয়, সেগুলোর অধিকাংশই পুরোনো। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ তা আগে থেকেই কম-বেশি জানে। এবার কেবল তা বড় একটি প্ল্যাটফর্মে একসঙ্গে উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রমিকনেত্রী নাজমা আক্তার বলেন, ‘আমরা আলাপ করি বেশি, কাজ করি কম। এখন কাজ বেশি করতে হবে, আলাপ কম করতে হবে। আর আমাদের অবশ্য অবশ্যই স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগোতে হবে।’ তিনি বলেন, পোশাক রপ্তানি ৫০ বা ১০০ বিলিয়ন ডলার হলে শ্রমিকেরা লাভবান হবেন। তাই আমাদের সাধ্যমত যা করার আছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে তা করব।’
সম্মেলন গত মঙ্গলবার শেষ হওয়ার পর পোশাকশিল্পের একাধিক উদ্যোক্তা ও শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা একবাক্যে বলেন, ‘সব দিক বিচারে এখন বাস্তবায়নই হচ্ছে মূল সমস্যা।’ অবশ্য এ কথাটি সম্মেলনে একাধিকবার উঠে আসে। সামিটের এক সেমিনারে অংশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগের জন্য অর্থায়ন কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে বাস্তবায়নে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতি স্থির নয়।’ অবকাঠামো উন্নয়নে আগামী ১০ বছরে সাত হাজার ৪০০ থেকে ১০ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে হবে বলে জানান তিনি।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘অবকাঠামো উন্নয়নের বিরাট কাজটি সরকারকে করতে হবে। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনতে হবে। কারণ, সময়মতো কাজ শেষ না হলে উল্টো সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেমন আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ছয় ঘণ্টায় যাওয়া যেত, এখন লাগে ১৬ ঘণ্টা।’
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা একটা পথনকশা তৈরি করতে চেয়েছি। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আমরা সফল। এবার পুরো পরিকল্পনাটি গুছিয়ে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দেব। একই সঙ্গে সরকারকে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানাব।’ তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বাড়ানোর জন্য এটি চাইছেন এমনটা ভাবলে ভুল হবে। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের বড় লক্ষ্য অর্জনে একটি কৌশল দরকার। শ্রমিক ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে বিজিএমইএর উচিত একটি প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ পণ্য কাঠামোর পরিবর্তন, মজুরি বৃদ্ধি, বিনিয়োগ, বিশ্ববাজার পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করে সেই তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় নিতে হবে। তারপর পরিকল্পনাটি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বা দর-কষাকষিতে যাওয়া উচিত।’
সিপিডির এই গবেষক আরও বলেন, পরিকল্পনা পাওয়ার পর সরকারের উচিত পোশাকশিল্পের গুরুত্ব বিবেচনা করে কীভাবে এটি গ্রহণ করবে সেটি নির্ধারণ করা। একই সঙ্গে প্রতিশ্রুতিশীল অন্যান্য রপ্তানি খাত যাতে চাপে না পড়ে, সেদিকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে। সব মিলিয়ে একটি সামগ্রিক শিল্পায়ন পরিকল্পনা করতে হবে সরকারকে। তারপর সব পক্ষকে নিয়ে বাস্তবায়নে নামতে হবে।