Published in Prothom Alo on Sunday, 9 February 2014.
ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০২০ সাল পর্যন্ত!
অরুণ কর্মকার
ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ কিনবে সরকার। এ-সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি এই সুপারিশ করেছে। সরকারও তাতে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (উন্নয়ন) প্রধান করে গত বছরের এপ্রিল মাসে আট সদস্যের ওই কমিটি করা হয়েছিল। কমিটিকে বলা হয়েছিল ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলো বেসরকারি খাতে বিদ্যমান আইপিপি (ইনডি-পেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) হিসেবে আইনি প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করা যায় কি না, তা নির্ধারণ করতে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের আগস্ট মাসে কমিটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে। তাতে বলা হয়, অনেক জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে এই কেন্দ্রগুলোকে আইপিপিতে রূপান্তর করা যায়। তার চেয়ে সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির বিধান অনুযায়ী কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া সহজতর হবে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম, চালানোর সময়, জ্বালানি সরবরাহ প্রভৃতি বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রতিবেদনটি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার পর এসব কেন্দ্র রাখার পক্ষেই বেশির ভাগ মতামত এসেছে। কারণ, বিদ্যুতের চাহিদা যে হারে বাড়ছে, তার তুলনায় উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের হার শ্লথ। তাই এই কেন্দ্রগুলো না রাখলে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা সম্ভব হবে না।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের পরিকল্পনায় ২০২১ সাল নাগাদ দেশীয় ও আমদানি করা কয়লা দিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা রয়েছে। কিন্তু দেশীয় কয়লা উত্তোলনে অনিশ্চয়তা ও আমদানি করা কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নানা কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতিও ভালো নয় এবং বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হচ্ছে না। অথচ বিদ্যুৎ চায় সবাই। এই প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ও মানুষের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজন আছে।
কমিটি হিসাব করে দেখিয়েছে, সরকারি পরিকল্পনাভুক্ত নতুন কেন্দ্রগুলো থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যদি মাত্র দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাওয়া যায়, আর ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলো যদি বন্ধ করা হয়, তাহলে বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দেবে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট। আর এই কেন্দ্রগুলো চালু থাকলে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা সম্ভব হবে।
কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে রাখার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মালিকেরাও অনেক দিন থেকে দাবি করে আসছিলেন। তিন ও পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য করা এ কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুতের দাম, ‘ক্যাপাসিটি পেমেন্ট’ প্রভৃতি নির্ধারণ করা হয়েছিল সেভাবে হিসাব করেই। কিন্তু ইতিমধ্যে মেয়াদ শেষ হওয়া কয়েকটি কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যগুলোর ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে সরকারি সূত্র জানিয়েছে।
যদিও সরকার বলেছিল, নিতান্তই বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণের আশু পদক্ষেপ হিসেবে তেলচালিত এ কেন্দ্রগুলো থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। এগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার মধ্যেই গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বড় কেন্দ্রগুলো চালু হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এই কেন্দ্রগুলো থেকে কেনা প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম পড়ে প্রায় ১৫ টাকা।
এ সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ প্রতিনিধি ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, আসলে ২০২০ সালের আগে কয়লাভিত্তিক কোনো বড় কেন্দ্রই উৎপাদনে আসবে না। তবে সার্বিক বাস্তবতা বিবেচনায় এগুলো রাখতে হলে বিদ্যুতের দাম সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, ইতিমধ্যে কেন্দ্রগুলোর বিনিয়োগ উঠে যাওয়ার কথা। আর একটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনায় নিতে হবে—কেন্দ্রগুলোর দক্ষতা। অদক্ষ কেন্দ্রগুলোকে রাখতে হলে তাদের ইঞ্জিন পুনঃস্থাপনের শর্ত পূরণ করিয়ে নেওয়া উচিত।
ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে সবচেয়ে বড় সমালোচনা ছিল এর দাম নিয়ে। এত দামে বিদ্যুৎ কিনলে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ার আশঙ্কাও অনেকে করেছিলেন। এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অবশ্যই নতুন করে মেয়াদ বাড়ানোর দায় বর্তাবে অর্থনীতির ওপর। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের অদক্ষতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে এসব উচ্চ দামের বিদ্যুৎ কিনতে হবে। সরকারের ‘আশু সমাধান’ দীর্ঘ ১০ বছরের মেয়াদে গড়াবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে পাওয়া বিদ্যুতের অবদানের বিষয় উঠে এসেছে। তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন এক কিলোওয়াট-ঘণ্টা বাড়লে সামষ্টিক অর্থনীতিতে উৎপাদন বাড়ে ৪৬ থেকে ১০৭ টাকা পর্যন্ত (১৯৯৫-৯৬ সালের মূল্যকে স্থির ধরে)। ২০১১-১২ অর্থবছরে জিডিপিতে ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুতের অবদান ২৩ হাজার ৩১২ থেকে এক লাখ ২১ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা (২০১১-১২ অর্থবছরের মূল্য বিবেচনায়)।
অবশ্য ওই গবেষণায় ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পেতে যে বিপুল ব্যয় হয় তা কিংবা সেই ব্যয়ের তুলনায় অর্থনীতিতে বিদ্যুতের অবদান পর্যালোচনা করা হয়নি।