Published in Banik Barta on Thursday, 3 April 2014.
ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ পাচার
এনবিআরের নতুন উদ্বেগ
মীর মনিরুজ্জামান ও খান এ মামুন
ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতি বছর বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর রাজস্ব ফাঁকির এ কৌশল নতুন উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। কারণ এমনিতেই বড় অঙ্কের রাজস্ব ঘাটতির শঙ্কায় রয়েছে সংস্থাটি।
প্রাথমিক অনুমানের ভিত্তিতে এনবিআর-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বছরে গড়ে ১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। একই সঙ্গে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পন্থায় স্থানান্তর হচ্ছে। বড় অঙ্কের ঘাটতির সময় ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মতো নতুন বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে এনবিআর। এরই মধ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আগামী বছর আইনটির বাস্তবায়ন শুরু হবে। একই সঙ্গে এ নিয়ে গোপনে কাজ শুরু করছে বিশেষ সেল।
এনবিআরের কর বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মোবাইল সিম, সিগারেটের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি, ভোগ্যপণ্যের কাঁচামালের মাধ্যমেই ট্রান্সফার প্রাইসিং করছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন নতুন পণ্য; যেগুলো আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বেশি দামে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কেনা হচ্ছে। এর মাধ্যমে পুঁজি পাচার হচ্ছে।
বাংলাদেশে ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকির বিষয় নিয়ে এনবিআর দুই বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করলেও তাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো কিছুই খোলাসা করা হচ্ছে না। তবে কয়েক বছর আগে ক্রিশ্চিয়ান এইডের এক হিসাবে দেখা গেছে, ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। এতে বলা হয়েছে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৩৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার রাজস্ব হারিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২০০৫ সালে হারিয়েছে ৬ কোটি ৫০ লাখ, ২০০৬ সালে ৭ কোটি ৮০ লাখ ও ২০০৭ সালে ২১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। পার্শ্ববর্তী ভারতে ছয় বছরে (২০০১-০৬) ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে ফাঁকি দেয়া ৫০০ কোটি ডলার উদ্ধার করেছে দেশটির রাজস্ব আহরণকারী সংস্থা। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে এখনো তদন্ত হয়নি।
শুধু রাজস্ব ফাঁকি নয়, একই সঙ্গে ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে মূলধন স্থানান্তর হয়েও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে মূলধন স্থানান্তর হয়েছে ১১৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানিগুলো স্থানান্তর করেছে ৪৪ কোটি ৯০ লাখ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিষ্ঠানগুলো ৭৪ কোটি ১০ লাখ ডলার।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার ঠেকাতে এনবিআরে সেল গঠন করা হয়েছে। এখানে একজন কো-অর্ডিনেটরও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অর্থ পাচার ঠেকাতে এ সেলকে শক্তিশালী করতে হবে। এনবিআর ও ব্যাংকগুলোর মধ্যে আরো বেশি সমন্বয় সাধন করতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করতে কর্মকর্তাদের আরো দক্ষ হতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় বড় অঙ্কের রাজস্ব ঘাটতিতে রয়েছে এনবিআর। এর মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চলেছে। ক্রমেই অঙ্কটা বড় হচ্ছে। একই সঙ্গে মূলধন স্থানান্তরের ব্যাপারটি নজরে এসেছে। ফলে বিষয়টি এনবিআরের কাছে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে রাজস্ব ফাঁকি বন্ধে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিশেষ সেল গঠন ও আইন প্রণয়নের কাজও শেষ হয়েছে।
এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিশেষ সেলের মাধ্যমে সন্দেহজনক আন্তর্জাতিক কেনাকাটায় বিশেষ নজরদারি করা হবে; যাতে এক্ষেত্রে রাজস্ব ফাঁকির কোনো ঘটনা আর না ঘটে।
জানা গেছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণেও অনেক সময় ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে বড় ধরনের রাজস্ব ফাঁকি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর ১৯৯০-৯৫ সালের মধ্যে রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৪০০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়। ইইউ গঠনের পর এর বাইরের দেশগুলো ইইউভুক্ত দেশগুলোয় অর্থ পাচার করছে। বাংলাদেশও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের ক্ষেত্রে উচ্চঝুঁকির মধ্যে অবস্থান করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সুশাসনের অভাব, রাজস্ব কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা ও আন্তরিকতার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতার কারণে ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ পাচারের সুযোগ নেয় বহুজাতিক কোম্পানি। এক্ষেত্রে রাজস্ব কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা ও আন্তরিকতা যত বাড়বে, রাজস্ব ফাঁকি তত কমবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা পণ্যের মূল্য নির্ধারণে খুব বেশি দক্ষ নন। এক্ষেত্রে বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তারা তাদের নির্ধারিত মূল্য প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি দক্ষ ও অভিজ্ঞ। সরকারের উচ্চমহলে তাদের প্রভাবও রয়েছে। এ কারণেই তাদের নির্ধারিত মূল্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তারা যদি সৎ ও আন্তরিক হন, তাহলে ফাঁকি অনেকটাই কমানো যাবে।