Published in Prothom Alo on Wednesday, 5 March 2014.
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব
গরিবের দেড় টাকা, ধনীর দুই পয়সা!
বিশেষ প্রতিনিধি
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সবচেয়ে গরিব আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি ইউনিট (এক কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের দাম এক টাকা ৩৭ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। আর সবচেয়ে ধনী আবাসিক গ্রাহকের প্রতি ইউনিটের দাম বাড়াতে বলেছে মাত্র দুই পয়সা।
কৃষি জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু পিডিবির প্রস্তাবে সেচপাম্পের জন্য প্রতি ইউনিটের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে এক টাকা ৪৯ পয়সা। সেচপাম্পে ব্যবহূত বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট এখন আছে দুই টাকা ৫১ পয়সা। পিডিবি করতে চাইছে চার টাকা।
সবচেয়ে গরিব আবাসিক গ্রাহকদের অবস্থান বিদ্যুতের গ্রাহকশ্রেণীর সর্বনিম্ন ধাপে। প্রতি মাসে তাঁরা সর্বোচ্চ ৭৫ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। পিডিবির বিতরণ এলাকায় এই শ্রেণীর গ্রাহকের জন্য প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বর্তমান দাম তিন টাকা ৩৩ পয়সা। এই দাম বাড়িয়ে চার টাকা ৭০ পয়সা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
সবচেয়ে ধনী আবাসিক গ্রাহকেরা প্রতি মাসে বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন ৬০০ ইউনিটের বেশি। তাঁদের ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রতি ইউনিটের দাম নয় টাকা ৩৮ পয়সা। এটা বাড়িয়ে নয় টাকা ৪০ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি।
এই হিসাবে দাম বাড়ানো হলে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারী গ্রাহকের প্রতি মাসে বিল বাড়বে ১০২ টাকা ৭৫ পয়সা। আর ৬০১ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিল বাড়বে ১২ টাকা ০২ পয়সা।
পিডিবির প্রস্তাবে সবচেয়ে গরিব ছাড়াও গ্রাহকশ্রেণীর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত গ্রাহকদের ক্ষেত্রেও মূল্যবৃদ্ধির হার অনেক বেশি রাখা হয়েছে। মাসে ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারী দ্বিতীয় ধাপের গ্রাহকের জন্য প্রতি ইউনিটের দাম এক টাকা ২৭ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তৃতীয় ধাপের ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর প্রতি ইউনিটের দাম এক টাকা ৪২ পয়সা এবং চতুর্থ ধাপের ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর প্রতি ইউনিটের দাম এক টাকা ৫৭ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর চেয়েও বেশি, মাসে ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিট ব্যবহারকারী ধনী গ্রাহকদেরও প্রতি ইউনিটের দাম এক টাকা দুই পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি। অথচ এদের চেয়েও ওপরের ধাপের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে প্রতি ইউনিটে মাত্র দুই পয়সা।
আবাসিক ছাড়া শিল্প, বাণিজ্যিক প্রভৃতি সব শ্রেণীর গ্রাহকের ক্ষেত্রেই বিভিন্ন হারে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে ধনী আবাসিক গ্রাহকদের জন্যই প্রস্তাবিত বৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন।
দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের যৌক্তিকতা সম্পর্কে পিডিবির বক্তব্য হচ্ছে—‘অন্যান্য জ্বালানির তুলনায় বিদ্যুতের যৌক্তিক মূল্যহার নির্ধারিত হলে বিদ্যুতের অপচয় ও চাহিদা হ্রাস পাবে এবং অতি প্রয়োজনীয় কাজে বিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত হবে।’
কিন্তু দরিদ্র মানুষ অপচয় ও অতি প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া বিদ্যুতের ব্যবহার করেন না। করেন ধনীরা। কাজেই বেশি দামের চাপে পড়ে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো সম্ভব ধনী গ্রাহকদের পক্ষে। গরিবদের ওপর যত চাপই দেওয়া হোক, বিদ্যুৎ ব্যবহার প্রান্তিক পর্যায়ে থাকায় তাঁদের পক্ষে তা আর কমানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিতে এভাবে দাম বাড়ানোর অভিঘাত সম্পর্কে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এর ফলে নিঃসন্দেহে কৃষির ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে দরিদ্র মানুষ আর্থিক চাপে পড়বেন। ভবিষ্যতে এভাবে দাম বাড়িয়ে যতবারই বিদ্যুৎ খাতের আয়-ব্যয়ে সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করা হবে, ততবারই নিম্ন আয়ের মানুষের ওপরই অপেক্ষাকৃত বেশি চাপ পড়বে। কারণ, উচ্চ আয়ের গ্রাহকের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধি আগেই একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বিদ্যুৎ খাতের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে ভর্তুকি কমানোর জন্য দাম বাড়ানোর এত বেশি চাপ অর্থনীতিকে নিতে হতো না। কাজেই শুধু দাম বাড়িয়ে সামঞ্জস্য আনার পরিবর্তে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কীভাবে কমানো যায়, এখন সেই দিকে বেশি নজর দিতে হবে।
দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্য গত পাঁচ বছরে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার তেলচালিত ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তিন ও পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য স্থাপন করা হয়। এসব কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম বেশি। কিন্তু পাঁচ বছরের মধ্যে কয়লা ও কিছু গ্যাসভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুতের দামে সামঞ্জস্য আনার পরিকল্পনা ছিল। কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কম। কিন্তু সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বড় কোনো কেন্দ্র চালু না হওয়ায় এবং বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনে বিরোধিতা থাকায় বেশি দামের তেলভিত্তিক কেন্দ্রই আরও বেশি দিন চালাতে হচ্ছে। বিদ্যুতের দামও বাড়ছে।
সব শ্রেণীর গ্রাহক মিলে গড়ে পিডিবি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সাড়ে ১৫ শতাংশ। পিডিবির এই প্রস্তাবের ওপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। তাতে বিইআরসির নিজস্ব কারিগরি মূল্যায়ন দল পিডিবির প্রস্তাব পর্যালোচনা করে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি যৌক্তিক হতে পারে বলে মত দিয়েছে।
কারওয়ান বাজারের টিসিবি ভবনে বিইআরসির কার্যালয়ে যখন এই শুনানি চলছিল, তখন ওই ভবনের সামনে চলছিল বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ও প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান সমাবেশ। গণসংহতি আন্দোলন আয়োজিত ওই অবস্থানে বিভিন্ন ছাত্র-গণসংগঠনের নেতারা বক্তব্য দেন।
শুনানিস্থলেও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন (ক্যাব), সিপিবি, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন প্রভৃতি দল ও সংগঠনের নেতারা দাম বাড়ানোর বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। তাঁরা পিডিবির প্রস্তাবের অসামঞ্জস্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন।
গতকাল বিকেলে শুনানি অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ওজোপাডিকো) দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে। ওজোপাডিকো খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ২১টি জেলার অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্ব পালন করছে। এই কোম্পানি গড়ে ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে।
বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন দল সেই প্রস্তাব পর্যালোচনা করে ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ বাড়ানো যৌক্তিক হতে পারে বলে মত দিয়েছে। ওজোপাডিকোর প্রস্তাবে সবচেয়ে ধনী ও সবচেয়ে গরিব গ্রাহকের জন্য প্রস্তাবিত মূল্যহারে পিডিবির প্রস্তাবের মতো আকাশ-পাতাল ব্যবধান বা অসামঞ্জস্য নেই।
তাদের প্রস্তাবে সবচেয়ে গরিব আবাসিক গ্রাহকের জন্য প্রতি ইউনিটে ১৭ পয়সা এবং সবচেয়ে ধনী আবাসিক গ্রাহকের জন্য প্রতি ইউনিটে ৮২ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
গ্রাহক জামানতও বাড়বে: পিডিবি বিদ্যুতের দামের পাশাপাশি গ্রাহকের জামানতও বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। প্রত্যেক গ্রাহককে তাঁর চাহিদার বিপরীতে প্রায় দুই মাসের আনুমানিক বিলের সমপরিমাণ অর্থ জামানত হিসাবে দিতে হয়। এখন পিডিবি প্রস্তাব করেছে, তিন মাসের গড় বিলের সমপরিমাণ কিংবা প্রতি কিলোওয়াট চাহিদার জন্য এক হাজার টাকা জামানত হিসাবে জমা দেওয়ার জন্য।
আরও শুনানি: দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় আজ বুধবার ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডেসকো) প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। কাল বৃহস্পতিবার গণশুনানি হবে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) প্রস্তাবের ওপর।
শুনানির ভিত্তিতে বিইআরসি ১৫ মার্চের মধ্যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে। তবে সে সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে ১ মার্চ থেকেই। অর্থাৎ সব গ্রাহককেই চলতি মার্চ মাসের বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে বর্ধিত দামে।
বিইআরসির সূত্রগুলো জানায়, কোম্পানি ও গ্রাহকশ্রেণী ভেদে ৬ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়তে পারে।