Published in Kaler Kantha on Tuesday, 18 February 2014.
জিএসপি ফেরতে রাজনীতিও শর্ত
বাংলাদেশিরাও ঢাকা দূতাবাস ও যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে নালিশ জানাচ্ছেন
আবুল কাশেম
এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপ। তার সঙ্গে আছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের নানা পক্ষের করা বিভিন্ন মাত্রার নালিশ। ফলে এ অবস্থায় স্থগিত হওয়া অগ্রাধিকার বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) ফেরত পাওয়ার আশা পুরোপুরি ছিল না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের। তার পরও যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ১৬ দফা শর্ত পূরণের মধ্য দিয়ে জোরগলায় দাবি করার পর্যায়ে যাওয়ার চেষ্টা ছিল সরকারের। কিন্তু সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক এই সুবিধা ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে এখন টেনে আনা হচ্ছে অবাণিজ্যিক নানা বিষয়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংলাপ শুরু এবং সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিশ্চিত করার শর্ত জুড়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এরই মধ্যে সরকারের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
সাভারের রানা প্লাজার ইথার টেক্স কারখানার শ্রমিক রেবা শিকদার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সভা-সেমিনারে অংশ নিচ্ছেন। গত ১১ ফেব্রুয়ারি সেখানে এক সেমিনারে যোগ দিয়ে রেবা বলেছেন, ইথার টেক্স কারখানায় কাজ করার সময় তাঁকে খুবই কম মজুরি দেওয়া হতো। তিন মাস চাকরি করার পর এক মাসের মজুরি পেতেন তিনি। রানা প্লাজা ধসে আহত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি নাকি কোনো সহযোগিতা পাননি। বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর এমন মৃত্যুফাঁদ রুখতে যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্রদের কঠোর ভূমিকা নেওয়ার অনুরোধ করেন রেবা শিকদার। বাংলায় দেওয়া তাঁর এই বক্তব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করে শুনিয়েছেন বিসিডাব্লিউএস নামের একটি এনজিওর নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার। এভাবে খোদ বাংলাদেশিরাই যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন, নালিশ জানাচ্ছেন।
কেবল বিদেশে গিয়ে নালিশ করাই নয়, দেশের ভেতরকার ছোটখাটো ঘটনার প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রেও সরকারের ওপর কোনো ভরসা নেই তাঁদের। তাই বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত কয়েকটি এনজিওর শ্রমিক নেতারা দ্বারস্থ হন বিদেশিদের কাছে। ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৯টি কারখানায় কিছু শ্রমিককে ছাঁটাই করা, মৌখিকভাবে গালাগাল করার মতো ঘটনার প্রতিকারও এসব শ্রমিক নেতা সরকারের কাছে চাননি। উল্টো তাঁরা প্রতিকার চেয়েছেন ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কাছে। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস আবার সেসব অভিযোগ শ্রম মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা সেসব ঘটনাকে ‘অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। সেই ১৯ কারখানার সমস্যা সমাধানে গতকাল সোমবার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে শ্রমিক ছাঁটাই না করতে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। শ্রমিক স্বার্থের নানা ঘটনার সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, জিএসপি ফিরে পেতে হলে দ্রুত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, জিএসপি ফেরত পাওয়ার জন্য প্রথমত যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ১৬টি শর্ত পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। তখন দেশটি রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বললে সেদিকেও নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো জিএসপি পুনর্বহালের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয়াদিও সামনে আনতে পারে। তাই জিএসপির জন্য সমান্তরালভাবে সরকারকে রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার জিএসপি পুনরুদ্ধার বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাজনৈতিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জিএসপি পুনর্বহালের জন্য যুক্তরাষ্ট্র লিখিতভাবে ১৬টি শর্ত দিয়ে তা বাস্তবায়নের কথা বললেও এখন এসবের সঙ্গে যোগ করেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইস্যুও। ঢাকায় দেশটির দূতাবাস সরকার-সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছে, জিএসপি পুনর্বহালের জন্য সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রয়োজন। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারকে সংলাপের মাধ্যমে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এমন বার্তা পাওয়ার পরই জিএসপি ফিরে পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে; যদিও ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের তথ্য তুলে ধরে আগামী ১৫ এপ্রিলের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তর ইউএসটিআরের কাছে অবস্থানপত্র পাঠাবে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ দফা শর্তের মধ্যে ১৩টি বাস্তবায়িত হয়েছে উল্লেখ করে ওই বৈঠকের দিনকয়েক আগে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, মার্চের মধ্যে বাকি শর্তগুলোও পূরণ করা হবে। তিনি আশা প্রকাশ করে তখন বলেছিলেন, জুনের মধ্যে স্থগিত হওয়া জিএসপি ফেরত পাওয়া যাবে।
এর কয়েক দিন পরই বৃহস্পতিবার তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কর্মপরিকল্পনায় যেসব শর্ত দিয়েছে, তা মার্চের মধ্যেই পূরণ করা হবে। কিন্তু জিএসপির সঙ্গে রাজনীতি ও ড. ইউনূস বিষয়ে শর্তারোপ করা হলে তা কখনোই পূরণ করা সম্ভব হবে না।
গত শনিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ প্রসঙ্গে বলেন, জিএসপি নিয়ে বিএনপির দুষ্টু পরামর্শে যুক্তরাষ্ট ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত ১১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। ওই সব বৈঠকের কথা তুলে ধরে দেশটিতে অবস্থিত বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলাম একটি ফ্যাক্সবার্তা পাঠিয়েছেন। ওই বার্তা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চা শক্তিশালীকরণের সঙ্গে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (ইপিজেড) ও পোশাক শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার বিষয়গুলো জুড়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট, ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর ডেমোক্রেটিক স্টাডিস একটি শুনানি করেছে।
শুনানি প্রসঙ্গে পরদিন এক ফ্যাক্সবার্তায় শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর রানা প্লাজা ধসের প্রভাব এখনো যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মনে তাজা। দি ইউনাইটেড স্টুডেন্টস এগেইনস্ট সুয়েটসপ কোয়ালিশন (ইউএসএএসসি) বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে খুবই সক্রিয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন চাপ প্রয়োগকারী গ্রুপ- শ্রমিক অধিকার রক্ষা গ্রুপ, ছাত্রসমাজ, ভোক্তা অধিকার রক্ষা গ্রুপ ও শিক্ষাবিদদের অবস্থান দেখে মনে হয়, শ্রমিক অধিকার রক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। বাস্তবতা বিবেচনায় কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত বাংলাদেশের আরো কঠোর ভূমিকা নেওয়া দরকার।’
ফ্যাক্সবার্তায় বলা হয়েছে, জিএসপি ফিরে পেতে হলে বাংলাদেশের শ্রমমান পরিস্থিতির আরো অনেক উন্নতি করতে হবে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। ওই শুনানিতে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সলিডারিটি সেন্টারের আইনজীবী এ কে এম নাসিম। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইপিজেডগুলোর শ্রমিকদের অধিকার শ্রম আইনের চেয়েও অনেক কম। ইপিজেডগুলোতে এখনো শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইপিজেডগুলোতে যে শ্রমিক কল্যাণ সমিতি রয়েছে, তা ট্রেড ইউনিয়নের ধারেকাছে নেই।
ফ্যাক্সবার্তার তথ্য অনুযায়ী, শুনানিতে অংশ নিয়ে রানা প্লাজা ধসে আহত ও ইথার টেক্স কারখানার শ্রমিক রেবা শিকদারের দেওয়া বাংলা বক্তব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনান বিসিডাব্লিউএসের নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার। যুক্তরাষ্ট্রে হওয়া ওই শুনানিতে রেবা শিকদার বাংলাদেশে এমন মৃত্যুফাঁদ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানান।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার কারণে ১৯ কারখানার শ্রমিক ছাঁটাই বা নির্যাতনের অভিযোগ সরকার পেয়েছে ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে। অর্থাৎ নিগৃহীত শ্রমিক বা তাদের নেতারা সরকারকে কিছুই না জানিয়ে নালিশ করতে চলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে। আবার বাংলাদেশিরাই যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে এ দেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়াচ্ছেন, দেশবিরোধী অবস্থান নিচ্ছেন। রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিক যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছেন। এসব ঘটনায় বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার ও কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছাচ্ছে।
পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, পরিবারে অনেক ছোটখাটো ঘটনা ঘটে, যা অনেক সময়ই অভিভাবককে জানানো হয় না। নিজেরাই তা মিটিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু পোশাক খাতে সামান্যতম ঘটনা ঘটলেই সরকারের কাছে তার প্রতিকার না চেয়ে কিছু এনজিও মুহূর্তের মধ্যে বিদেশিদের কাছে নালিশ জানাচ্ছে। এটি কোনোমতেই কাম্য নয়। কারণ শিল্পের স্বার্থে মালিক-শ্রমিকদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সমস্যা হলে তার সমাধান নিজেদেরই করতে হবে।
গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, অনেক সময়ই মালিকদের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে অভিযোগ করে শ্রমিকরা কোনো ফল পায় না। ফলে অনেকে অন্যদের দ্বারস্থ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শ্রমিক নেতাদের অবশ্যই দেশপ্রেমিক হতে হবে। শুরুতে সরকারকে জানানোর পর তাতে ফল পাওয়া না গেলে তখন সংবাদ সম্মেলন, আইনগত উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। অন্য দেশের কাছে নালিশ করার প্রবণতা কোনোমতেই ঠিক নয়।