Published in Alokito Bangladesh on Saturday, 24 January 2015.
হরতাল-অবরোধের কোপ অর্থনীতিতে
এসএম আলমগীর
টানা অবরোধের প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। শিল্পের উত্পাদন নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রফতানি বাণিজ্য। তৈরি পোশাক শিল্পের গ্রীষ্মকালীন রফতানি আদেশ চলে যাচ্ছে অন্য দেশে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা পুঁজিহারা হচ্ছেন। অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটায় পচনশীল পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষকের উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য দূরে থাক, খরচ ওঠানোও সম্ভব হচ্ছে না। নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংক-বীমা খাতেও।
উদ্যোক্তারা বলেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় তাদের যে ক্ষতি হচ্ছে তা কোনোভাবেই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে ফুরিয়ে আসছে এ খাতের কাঁচামালের মজুদ। যেকোনো সময় উত্পাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে শতাধিক কারখানার। বন্দর থেকে পণ্য খালাস করতে না পারায় প্রতিদিন গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। এ ছাড়া এ খাতের যেসব ক্রেতা একবার বাংলাদেশের বাজার ছেড়ে চলে যায় তাদের আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়া নিটওয়্যার খাতের উদ্যোক্তারা জানান, ইতোমধ্যে তাদের ৪০ শতাংশ রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে। এ ছাড়া উদ্যোক্তারা ক্রমেই ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছেন বলেও জানান তারা।
সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান সকালের খবরকে বলেন, চলমান হরতাল-অবরোধে অর্থনীতির তাত্ক্ষণিক ক্ষতি, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে। তাত্ক্ষণিক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে-শিল্পের উত্পাদন ব্যাহত হওয়া, কৃষিপণ্য নষ্ট হওয়া এবং ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে কৃষকের বঞ্চিত হওয়া, রফতানি বাধাগ্রস্ত হওয়া, স্বল্প আয়ের মানুষের আয় কমে যাওয়া। মধ্যমেয়াদি ক্ষতির মধ্যে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হবে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। এই পরিস্থিতিতে দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেসব বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেগুলো বন্ধ করে দেবেন। আর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মধ্যে সরকারের যেসব বড় প্রকল্প রয়েছে সেগুলোও থমকে যাবে। তিনি আরও বলেন, সার্বিক দিক বিবেচনা করে বলা যায়-এই হরতাল-অবরোধ জিডিপির প্রবৃদ্ধি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। এ কারণে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে এমন কোনো কর্মসূচি রাজনৈতিক দলগুলো যেন না দেয়। আর রাজনৈতিক অস্থিরতা দ্রুত নিরসনে একটা সমঝোতায় আসা এখন সময়ের দাবি।
রফতানি বাণিজ্যের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের এখন গ্রীষ্মকালীন রফতানি আদেশ আসার সময়। কিন্তু রফতানি আদেশ এখন চলে যাচ্ছে প্রতিযোগী দেশগুলোতে। বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ জানান, তার কারখানার কয়েক মিলিয়ন ডলারের রফতানি আদেশ ফিরিয়ে নিয়েছেন ক্রেতারা। এ ছাড়া অন্য কারখানা মালিকরা জানিয়েছেন, এ সময় যে হারে রফতানি আদেশ তারা পেতেন এখন পাচ্ছেন তার মাত্র ১২ থেকে ১৩ শতাংশ। এ ছাড়া গার্মেন্ট কারখানায় এখন উত্পাদনও অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর প্রধান কারণ বিদেশ থেকে আনা অনেক কাঁচামাল বন্দর থেকে আনা যাচ্ছে না। অনেক কারখানা এখন কাঁচামালের অভাবে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা খোলা থাকছে।
ইতোমধ্যেই চলমান পরিস্থিতির কারণে অনেক কারখানা মালিক দশগুণ বেশি খরচে বিমানে পণ্য পাঠাচ্ছেন, কেউ অর্ধেক মূল্যে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য বিক্রি করে দিচ্ছেন, আবার অনেকে শিপমেন্ট বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছেন। তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে উদ্যোক্তাদের ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার এয়ার শিপমেন্ট করতে হয়েছে। আর ৯ হাজার কোটি টাকার পণ্য ডিসকাউন্ট হয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আমাদের তৈরি পোশাক রফতানিতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬.৮৯ বিলিয়ন ডলার, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ২ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসেবে এক দিন অবরোধ-হরতাল থাকলে ৬৯৫ কোটি টাকার পোশাক রফতানি বাধাগ্রস্ত হয়। আর প্রতিদিন এই শিল্পে প্রকৃত উত্পাদনের মূল্যমান হচ্ছে প্রায় ৪৩০ কোটি টাকা। যদি উত্পাদন হরতাল-অবরোধের কারণে ৫০ শতাংশও বিঘ্নিত হয়, তাহলে প্রতিদিন উত্পাদন ব্যাহত হয় অন্তত ২১৫ কোটি টাকার।
তিনি বলেন, আমরা মরতে চাই না, বাঁচতে চাই। আমরা চাই যে শিল্প খাতকে কেন্দ্র করে দেশে বিভিন্ন ফরোয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প খাত বিশেষ করে সুতা, বোতাম, জিপার, ডাইং, ফিনিশিং, পলিব্যাগসহ বিভিন্ন এক্সেসরিজ শিল্প গড়ে উঠেছে। সহায়ক শিল্প হিসেবে ব্যাংক-বীমা, শিপিং, সিএনএফ সেবা খাত, পর্যটন, হোটেল, পরিবহন, আবাসন, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাত প্রসার লাভ করেছে। সেই সঙ্গে এসব শিল্প খাতে ৫ থেকে ৬ কোটি লোকের জীবন নির্বাহের ব্যবস্থা হয়েছে। সুতরাং রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে এসব শিল্পকে কোনোভাবেই ধ্বংস করা যাবে না।
শিল্প খাতের মতো খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পরিবহন সঙ্কটের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শাকসবজি। এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে পাঠানো সম্ভব না হওয়ায় কৃষকও বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায্যমূল্য থেকে। গত কয়েক বছর ধরেই দেশে খাদ্যপণ্য মূল্য স্থিতিশীল থাকায় মূল্যস্ফীতি ছিল নিয়ন্ত্রণে। অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এই ধারাবাহিকতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভোগ্যপণ্য পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় বাজারেও নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে-কৃষক তার কষ্টার্জিত ফসল ক্রেতার অভাবে ফেলে দিচ্ছেন। এতে করে কৃষক ফসল উত্পাদনে নিরুত্সাহিত হবেন।
একই অবস্থা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের। বড় বড় শিল্প খাতের শুধু নয়, যারা জীবনধারণের জন্য ক্ষুদ্র উদ্যোগ নিয়ে বেঁচে আছেন, তাদের অবস্থা খুবই সঙ্গিন। এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় অজানা আগামীর পথে দাঁড়িয়ে তারা। যাদের কেউ চাকরি দেয়নি, দেয়নি আর্থিক সহায়তাও। সম্পূর্ণ নিজ চেষ্টায় সামান্য পুঁজি দিয়ে ফুটপাতে কিংবা ছোট্ট পরিসরে আয়ের ব্যবস্থা করেছেন তারা। দিনের বিক্রি দিয়েই দিনের খরচ। এসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা পুঁজিহারা হয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অঞ্চলভিত্তিক পণ্য উত্পাদন ও ব্যবসাকেন্দ্র রয়েছে। যেসব স্থান থেকে দেশের অপর প্রান্তের ভোক্তাদের কাছে পণ্য পৌঁছানো হয়ে থাকে। অবরোধ-হরতালে সবই বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে খাদ্যপণ্যের মতো জরুরি বিষয়গুলো নিয়েও চিন্তার কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
খুলনা-যশোর অঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৩৫টি পাটকল রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ৯টি ও বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা ২৬টি। বর্তমানে ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে প্রায় ২শ’ কোটি টাকার পাটজাতপণ্য অবিক্রীত অবস্থায় রয়েছে। খুলনা রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্র জানায়, খুলনার পাট ও পাটজাত পণ্য চীন, ভারত, পাকিস্তান, বুলগেরিয়া, পর্তুগাল, রাশিয়া, তুরস্ক, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, জাপান, গ্রিস, ইতালি, স্পেন, চেক রিপাবলিক, কানাডা, জার্মানি, কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও বেলরুশসহ বিশ্বের ২৪-২৫টি দেশে রফতানি হয়। কিন্তু এসব পাটকল থেকে এখন রফতানি একেবারে বন্ধের উপক্রম। আর পণ্য রফতানি করতে না পারায় কারখানা মালিকদের পুঁজি আটকা পড়ছে।
বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন (বিজেএমসি) সূত্র জানায়, খুলনা অঞ্চলের ৯টি রাস্ট্রায়ত্ত জুট মিলে বর্তমানে ২১ হাজার ২০১ টন হেসিয়ান, সিবিসি, ইয়ার্ন ও স্যাকিং পাটজাত পণ্য মজুদ রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ২০১ কোটি টাকা। রাজনৈতিক অস্থিরতা যুক্ত হওয়ায় সুদূরপ্রসারী ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে মিল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে হরতাল-অবরোধের প্রভাব ব্যাংক-বীমা খাতেও পড়েছে। বীমা খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বীমা শিল্পে প্রতিদিন আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। ২০১৩ সালে হরতাল-অবরোধে বীমা খাতে ক্ষতির পরিমাণ ছিল হাজার কোটি টাকার বেশি। একই বছর মোট জাতীয় আয়ে বীমার অবদান দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ কমে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে চলতি বছরে এ খাতের অবদান আরও কমবে বলে জানান ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন।