জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে আসছে নতুন মুদ্রানীতি। সহিংস রাজনৈতিক কর্মকা-ের কারণে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা, থমকে যাওয়া বিনিয়োগে গতি আনা ও উৎপাদন ব্যবস্থাকে সচল করা করাই হবে এ মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, অর্থনীতির চালিকা শক্তিগুলোর সমন্বয় করাই নতুন মুদ্রানীতির উদ্দেশে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাসান জামান সংবাদকে জানান, অর্থনীতির স্থানীয় ও বৈশ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে। এ মুদ্রানীতিতে বিবেচনা থাকবে সমসাময়িক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রটি জানায়, বর্তমান মুদ্রানীতির ন্যায় বছরের শেষ মুদ্রানীতিও হবে সমন্বয়মূলক ও ভারসাম্যমূলক অথনীতি। এ সময়ে যেখানে অর্থের সরবারহ বৃদ্ধির দরকার সেখানে সরবারহ বাড়াবে। যেখানে সংকোচন করার প্রয়োজন সেখানে সংকোচন করা হবে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংতার কারণে বিনিয়োগে নিরুৎসাহ, সরবারহ ভেঙে পড়া, উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাওয়ার ও বিকল্প পথে রপ্তানি করার কারণে ব্যবসায়ীদের মুনাফা কমে যাওয়ায় নতুন করে বিনিয়োগের জন্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদি পরিস্থিতির আলোকে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে।
সূত্রটি জানায়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতে পারে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। তবে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে পর্যন্ত রাখাই হবে মুদ্রানীতির লক্ষ্য। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ কার্যক্রমে বড় ধরনের গতিশীলতা না আনা গেলে প্রবৃদ্ধির বাস্তব অর্জন বিগত দশ বছরের গড় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ শতাংশের চেয়ে খুব একটা বেশি হবার সম্ভাবনা কম। যদিও সরকারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যাশা, আগামীতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়বে। এর আগে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমিয়ে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম মেয়াদের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কম থাকলেও আগামী ৬ মাসে এটি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা আমদানি-রপ্তানির গত ৫ মাসের গতি ধারা থেকে বোঝা যাচ্ছে এটি আগামীতে আরও বাড়বে। এর পাশাপাশি সেবা ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি জানান, বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ তাদের মতামত ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছেন। তারা সবাই প্রবৃদ্ধি সহায়ক ভারসাম্যপূর্ণ মুদ্রানীতির পক্ষে মতামত দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগ ও প্রকৃত উৎপাদনের সঙ্গে জোগানও বাড়বে। যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এটিও ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের গতি কিছুটা কমে আসা ও টাকার সরবরাহও কাঙ্ক্ষিত না হওয়ার পরও কেন মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেল।
এদিকে নতুন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব বিষয় বিবেচনা করে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের যে মুদ্রানীতি তৈরি হবে সেখানে চলতি মুদ্রানীতির অবস্থান প্রায় অপরিবর্তিত রাখা যেতে পারে। তবে নতুন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার ওপর বেশি জোর দেয়া উচিত হবে।
এছাড়া মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বেশকিছু ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সাম্প্রতিক সাধারণ ধর্মঘট এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বৈরীভাবাপন্ন পরিস্থিতি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে বড় হুমকি বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) বৃদ্ধির লক্ষে ব্যাপক মুদ্রাবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভমানি, বেসরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধি, সরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধি প্রভৃতিকে কাজে লাগিয়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনকেই লক্ষ্যমাত্রা করা উচিত। প্রবৃদ্ধি বেশি হলে কিছুটা মূল্যস্ফীতি সহনীয় হতে পারে। তাই ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের জন্য মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য এবং সেক্ষেত্রে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি ১৭ দশমিক ২ থেকে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। পাশাপাশি পরবর্তী মুদ্রানীতিতে সরকারি খাত এবং তৈরি পোশাক খাতে মজুরি বৃদ্ধিজনিত এবং তার ফলে অর্থনীতির অন্যান্য খাতে প্রভাবের ফলে তারল্যজনিত চাপ মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ থাকবে। এটা আশা করা যায়, নির্বাচনোত্তর সময়ে বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরে আসবে, সেক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বাড়ানো যেতে পারে। নির্বাচনকালীন সময়েও বিনিময় হার আগের মতোই ছিল, তবে নির্বাচনোত্তর সময়ে পরিস্থিতি বিবেচনায় পুঙ্খানুপুঙ্খ তদারকি ও সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে। মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে তা যাইহোক, প্রয়োজন হবে ব্যাংক ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবীক্ষণ ও অনুসন্ধান জোরদার করা। মুদ্রানীতিকে প্রবৃদ্ধি অর্জনে আরও সহায়ক করা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান এক সাক্ষাৎকারে সংবাদকে বলেন, সহিংস রাজনৈতিক কারণে দেশের বেসরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে, দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক ক্রেতারা সতর্ক করে দিয়েছে, রপ্তানিকারক আকাশপথে রপ্তানি করার কারণে অতিরিক্ত খরচের মুখোমুখি হয়েছে; দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সৃষ্টিকারী কৃষি খাতেও ইনপুট ব্যাহত করেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণ করাই মুদ্রানীতির প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।