Published in The Daily Ittefaq on Friday, 31 January 2014.
রাজনৈতিক অস্থিরতায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি
রিয়াদ হোসেন
সদ্য সমাপ্ত বছরের শেষ কয় মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় কোপ পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। ব্যবসা বাণিজ্য স্থবির হওয়া, আমদানি কমে যাওয়ায় সার্বিক রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি সামপ্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রকাশিত হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী অর্থবছরের প্রথমার্ধে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ৭ হাজার ১৮১ কোটি টাকা। অর্থবছরের বাদবাকী সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলেও রাজস্ব আহরণে বিশেষ গতি আসবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এই পরিস্থিতিতে ব্যয়ের যোগান দিতে শেষ পর্যন্ত সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে যাওয়ার আশংকা তাদের। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে এই অবস্থায় বিশাল লক্ষ্যমাত্রা খানিকটা কমিয়ে আনতে যাচ্ছে সরকার।
চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা ঠিক করেছে সরকার। গত জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৫৭ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলেও আদায় হয়েছে ৫০ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা। বিশেষত গত ডিসেম্বর মাস জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেশি থাকায় আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন তো হয়ইনি বরং পূর্বের বছরের একই সময়ের তুলনায়ও কমেছে ১৪৭ কোটি টাকা।
রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ ও সহায়তা দিতে সরকারের কাছে ব্যবসায়ীদের দাবির ফর্দ দীর্ঘ হচ্ছে। ইতিমধ্যে রফতানিকারকদের উেস কর দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৩০ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এনবিআরের হিসাবে, এর ফলে এই খাত থেকে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব কমে যাবে।
এসব বিবেচনায় রাজস্ব আদায়ে চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হবে বলে মনে করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, এত বড় ঘাটতিতে শেষ পর্যন্ত ব্যয় মেটাতে সরকারকে ব্যাংক ঋণ বাড়াতে হবে। তবে ইত্তেফাককে তিনি জানান, ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত তারল্য থাকায় সরকারের ব্যাংক ঋণ বাড়লেও তাতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে তেমন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
চলতি অর্থবছরে অবকাঠামোসহ উন্নয়ন ব্যয় কমলেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতাসহ বিভিন্ন সুবিধা বাড়ানোর ফলে অনুন্নয়নখাতে ব্যয় বাড়বে। এসব বিবেচনায় রাজস্ব আদায় বাড়ানোর দিকে মনযোগী হওয়াকেই নিরাপদ মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক চেহারা ফিরে পাচ্ছে। এই অবস্থায় ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় বাড়াতে এনবিআরের কার্যক্রমে আরো গতি আনার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির বর্তমান স্থিতিশীলতাকে দীর্ঘমেয়াদী মনে করেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এ বিষয়ে ইত্তেফাককে তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের শঙ্কা কাটেনি। এর ফলে আগামী দিনগুলোতে রাজস্ব আদায়ে বিশেষ উন্নতি হওয়ার লক্ষণ নেই। হুট করে আদায় বাড়ানো সম্ভবও নয়। এই অবস্থায় ব্যয় মেটাতে সরকার সহজ উত্স হিসেবে ব্যাংক ঋণের দিকেই ঝুঁকবে। তবে এক্ষেত্রে কম প্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাদ দিয়ে খরচের কিছুটা লাগাম টানা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
চলতি অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে সরকার নীট ঋণ নিয়েছে ৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণে ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের ঋণ সুযোগ সংকুচিত হওয়ার আশংকা করছে ব্যবসায়ীরা। ঢাকা চেম্বার ও মেট্রোপলিটন চেম্বারসহ ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের লক্ষ্যমাত্রার বেশি ঋণ গ্রহণ না করার দাবি জানানো হয়েছে।
এদিকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা করতে যাচ্ছে সরকার। এ বিষয়ে এনবিআর একটি প্রাথমিক প্রস্তাব তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। সমপ্রতি এনবিআরের এক বৈঠকে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর আভাসও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।