Published in Banik Barta on Tuesday, 11 February 2014.
তৈরি পোশাক খাত
ক্রয়াদেশ না পাওয়ার ঝুঁকিতে ৪০% কারখানা
বদরুল আলম
দেশে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে। কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে এসব কারখানায় ক্রয়াদেশ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিদেশী ক্রেতারা। এরই মধ্যে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও শুরু করেছেন কেউ কেউ। ফলে ক্রয়াদেশ না পাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে ৪০ শতাংশ তৈরি পোশাক কারখানা।
পোশাক কারখানার পাশাপাশি অন্য প্রতিষ্ঠানও রয়েছে, এমন ভবনকেই বলা হচ্ছে শেয়ার্ড বিল্ডিং। চট্টগ্রামের ৮০ শতাংশ পোশাক কারখানাই গড়ে উঠেছে এ ধরনের ভবনে। পাশাপাশি রাজধানীর মিরপুর, মালিবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা, মোহাম্মদপুরসহ আশুলিয়া ও গাজীপুরেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পোশাক কারখানা রয়েছে এ ধরনের ভবনে। বিজিএমইএর হিসাবে, সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ৩০-৪০ শতাংশ কারখানা শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
জানা গেছে, রানা প্লাজা ধসের আগেই শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে ক্রয়াদেশ দেয়ার বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন শুরু করে এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট ও জেসি পেনির মতো প্রতিষ্ঠান। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পর এসব কারখানায় ক্রয়াদেশ বন্ধ করে দেয় তারা। এখন লি অ্যান্ড ফাং, সিঅ্যান্ডএ, কুল্্স, টারগেট, কে-মার্ট ও গ্যাপের মতো ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানও একই পন্থা অবলম্বন করবে বলে খাতসংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দিয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, অনেক ক্রেতাই শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে আর ক্রয়াদেশ না দেয়ার কথা জানিয়েছেন। কিছু প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও শুরু করেছে।
শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে কারখানা আছে, এমন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও ক্রয়াদেশ না পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। চট্টগ্রামের এক উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শেয়ার্ড বিল্ডিংসহ নিজস্ব ভবনে আমার মালিকানাধীন কারখানা রয়েছে। নিজস্ব ভবনের কারখানায় ক্রয়াদেশ পেলেও শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে পাওয়া যাচ্ছে না।’
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহযোগিতায় তৈরি পোশাক কারখানার পরিদর্শন কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন বুয়েটের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, শেয়ার্ড বিল্ডিং যদি যথাযথ স্থাপত্য নকশা মেনে তৈরি হয়, তাহলে নিরাপত্তা ঝুঁকির কোনো কারণ থাকার কথা নয়।
এদিকে শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ের বিষয়টি সামনে এনে ক্রয়াদেশ না দেয়ার বিষয়ে ক্রেতাদের সিদ্ধান্তকে হঠকারী হিসেবে দেখছেন পোশাক শিল্প মালিকদের কেউ কেউ। তাদের দাবি, অনেক ক্রেতা শুধু সুনাম রক্ষার স্বার্থে ক্রয়াদেশ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। এতে কোনো কোনো উদ্যোক্তা ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন বিপুলসংখ্যক শ্রমিক।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজীম এ প্রসঙ্গে বলেন, বাস্তবতার কারণেই শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে কারখানা গড়ে উঠেছে। ওইসব কারখানার কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনা ভালো হলে ক্রয়াদেশ বন্ধ করে দেয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ থাকতে পারে না। যাচাই-বাছাই ছাড়া ক্রেতাদেরও এমন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যাগুলো পুরনো হলেও তা সমাধানের প্রক্রিয়া এত দিনেও শুরু করা যায়নি। সরকারের উচিত হবে অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সমস্যাটির সমাধান করা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কারখানা মালিকদের অনন্তকাল সময় দেয়া ঠিক হবে না। শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ের কারখানা স্থানান্তরে ক্রেতাদের উচিত উদ্যোক্তাদের সুনির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া। আবার কারখানার মানোন্নয়নে কোনো আপস যেন না করা হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
উল্লেখ্য, শ্রম ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নে অ্যালায়েন্স, অ্যাকর্ড ও জাতীয় কর্মপরিকল্পনার ত্রিপক্ষীয় কমিটির (এনটিসি) আওতাধীন কারখানার সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার। এর মধ্যে ৪০০ কারখানার প্রাথমিক পরিদর্শন শেষ হয়েছে। বাকি চার হাজার কারখানার পরিদর্শন এখনো শুরু হয়নি। এমন একটি সময়ে ক্রেতাদের শেয়ার্ড বিল্ডিং-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত উদ্যোক্তাদের উদ্বেগে ফেলেছে।
তাজরীন ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর কারখানার নিরাপত্তা সমস্যা চিহ্নিত করতে বুয়েটসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান একাধিক সমীক্ষা চালিয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) এক সমীক্ষার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, ১৯৯০ সালের আগে নির্মিত ৭ শতাংশ পোশাক কারখানা পুরনো ভবনে গড়ে উঠেছে। মোট ৩৭ শতাংশ কারখানা নির্মাণ হয়েছে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে। ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত নির্মিত কারখানা ২৫ শতাংশ। ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গড়ে ওঠা কারখানা ৩০ শতাংশ। সমীক্ষার আওতায় থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে ৫০ শতাংশ নিজস্ব ভবনে গড়ে উঠেছে। ৬৫ শতাংশ কারখানা ভবন ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা হয়। ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা এসব কারখানার অধিকাংশই মানে উত্তীর্ণ নয়।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০০০ সালের আগে নির্মিত প্রায় ২৫ শতাংশ কারখানা ভবনের স্থাপত্য নকশার অনুমোদন নেই। ২০০০ সালের পরে নির্মিত ভবনগুলোর মধ্যে নকশা অনুমোদন হয়েছে ৮৫ শতাংশের। অগ্নিনিরাপত্তাবিষয়ক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ৯২ শতাংশ কারখানার অগ্নিনিরাপত্তা অনুমোদন আছে। ক্ষুদ্রগুলো ছাড়া অন্য সব কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ৭৫ শতাংশ কারখানা দাবি করে, তাদের ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণে ব্যবস্থা রয়েছে। এসব কারখানার মাত্র ১৫ শতাংশ শ্রমিক ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ থেকে অগ্নিবিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
সমীক্ষার বৈদ্যুতিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে দেখা যায়, ৪৫ শতাংশ কারখানার ভেতরে নিচতলায় বৈদ্যুতিক জেনারেটর রয়েছে। এ কারখানাগুলোর মধ্যে ৫৫ শতাংশ কারখানা ছোট। বাকি সব কারখানায় ভবনের বাইরে স্থাপন করা হয়েছে জেনারেটর। ক্ষুদ্র কারখানাগুলোয় বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে দুর্বল। বেশির ভাগ ছোট কারখানার কমপ্লায়েন্স মানদণ্ডও নাজুক।