Published in Jaijaidin on Sunday, 1 March 2015.
সুবিধা আদায়ে পোশাক ব্যবসায়ীদের দৌড়ঝাঁপ
আজ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক :হরতাল-অবরোধে ক্ষতির দোহাই দিয়ে প্রণোদনা দাবি
আহমেদ তোফায়েল
জনগণের করের টাকায় হরতাল-অবরোধের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বরাবরের মতো আবারো একগুচ্ছ সুবিধা আদায়ের জন্য মাঠে নেমেছেন বস্ত্র ও পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। তবে ঢালাওভাবে ব্যবসায়ীদের এ মুহূর্তে কোনো সুবিধা দেয়ার যৌক্তিক কারণ আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ অর্থমন্ত্রী এবং আর্থিক খাত বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না করে করের টাকায় প্রণোদনায় অর্থনীতিকে টেকানো যাবে না। অন্যদিকে রপ্তানি খাতের ব্যবসায়ীরা চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার দোহাই দিয়ে যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির কথা বস্ত্র এবং পোশাক খাত মালিকদের পক্ষে বলা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে সে পরিমাণ ক্ষতি বা ক্রয়াদেশ তাদের বাতিল হয়নি। বরং পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক মনে করে ক্রেতারা নতুন করে ক্রয় আদেশ দিতে শুরু করেছেন।
আর রপ্তানি খাতকে উদ্দেশ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি বলেছেন, চলমান হরতাল-অবরোধের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটায় সমাজের নিম্নআয়ের মানুষ পথে বসে গেছে। তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ হরতাল-অবরোধে তাদের ক্ষতির বিবরণ নিশ্চয়ই সরকারের কাছে তুলে ধরবে। তবে হরতাল-অবরোধে কারখানাগুলোতে উৎপাদন বন্ধ হয়নি। বিজিএমইএ ‘সাফার’ করেনি। এটা তার অ্যাসেসমেন্ট।
বস্ত্র ও পোশাক খাতে প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, নগদ সহায়তা তারা (বস্ত্র ও পোশাক খাত) এমনিতেই পেয়ে আসছেন। যে সমস্যার জন্য তারা সুযোগ-সুবিধা চাইছেন আগে তার সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শুধু বস্ত্র ও পোশাক খাতে নয়, অন্য সব খাতেও সমস্যা হচ্ছে। তবে রাজস্ব আয়ের ওপর নির্ভর করবে সরকার সহায়তা করতে পারবে কিনা। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় সবসময়ই রাজস্ব আদায়ে বড় আকারের ধাক্কা আসে। স্থানীয় উৎপাদক, ক্ষুদ্র উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারক আছেন, সবারই অসুবিধা হচ্ছে। তিনি বলেন, মোদ্দাকথা সুবিধা দিলে সবাইকেই দেয়ার প্রশ্ন আসবে। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না করে যদি রাজস্ব পন্থায় সমাধান হয়, তাহলে সরকার অর্থনীতিকে বেশি টেকাতে পারবে না বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে কর আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এ সময়ে ৬৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে সংস্থাটি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে লক্ষ্যমাত্রার অর্জনে ২ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। গত অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ে ৪ হাজার ৩৮০ কোটি ৪২ লাখ টাকার ঘাটতি ছিল। রাজস্ব আয় বিবেচনা করে প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে পোশাক মালিকদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘অধুনা আমাদের দেশে একটি লক্ষণীয় বিত্তশালী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সরকার সবসময় তাদের কাছ থেকে যথাযথ রাজস্ব বা কর আদায় করতে পারে না।’
বস্ত্র ও পোশাক খাতের কয়েক জন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ খাতের নেতারা যেভাবে ক্ষয়-ক্ষতি এবং ক্রয় আদেশ কমে যাওয়ার তথ্য গণমাধ্যমে দিচ্ছেন, তা পুরোপুরি ঠিক নয়। এছাড়া এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। ক্রয় আদেশ নিয়ে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল তা কাটতে শুরু করেছে। আসতে শুরু করেছে ক্রয় অর্ডার। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে ক্রেতারা মূল্য কম বলছে। তারা আগের চেয়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ মূল্য কমিয়েছে। ক্রেতারা এখনো বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। তারা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে মাত্র। বিজিএমইএর এক প্রভাবশালী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আসলে হরতাল অবরোধ তাদের সহনীয় হয়ে গেছে। রপ্তানি কারোর থেমে নেই। পুলিশ প্রশাসন বা যেভাবেই হোক ক্রেতাদের কাছে পণ্য পাঠানো হয়েছে। হয়তো বা পরিবহন ভাড়া একটু বেশি পড়েছে। হরতাল অবরোধে যে পরিমাণ ক্ষতির কথা মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সে পরিমাণ ক্ষতি বা অর্ডার বাতিল হয়নি। তবে পরিস্থিতি এখন পরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বস্ত্র ও পোশাক খাতের মালিকরা সরকারকে কর দেন অল্পই, কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি টাকার নগদ সহায়তা নিয়ে যান সরকার থেকে। অন্যরা সরকারকে যে পরিমাণ কর দেন, তার দশ ভাগের একভাগও পোশাক খাত থেকে সরকার পায় না। পোশাক মালিকদের কাছ থেকে সরকার আয়করও পায় সামান্য। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নথি অনুযায়ী, অধিকাংশ পোশাক মালিক অল্পই আয় করেন। আয়করও দেন অনেক কম। পোশাক মালিকদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকিরও নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে এনবিআরে। পোশাক খাতের জন্য রয়েছে সরকারের নানা ধরনের সুবিধা। কাঁচামাল আনা থেকে শুরু করে রপ্তানি পর্যন্ত, প্রতিটি পর্যায়েই এই খাতকে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা।
জানা গেছে, এবারের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের কাছে বিশেষ সুবিধা চায় বস্ত্র ও পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে নগদ সহায়তাসহ স্বল্প মেয়াদে সুদমুক্ত ঋণ চান উদ্যোক্তারা। নতুন বাজারে রপ্তানিতে বিদ্যমান নগদ সহায়তা ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করতে সরকারের কাছে দাবি জানানো হবে। আগামী রোববার এসব দাবিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে সাক্ষাৎসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি দেবে বস্ত্র ও পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলো।
তাদের অন্য দাবির মধ্যে রয়েছে, ঋণ পরিশোধে সময় দেয়া, বন্দরের কাছে অতিরিক্ত মাশুল বকেয়া থাকলে অব্যাহতি দেয়া। বীমার প্রিমিয়াম যাতে হ্রাস করা হয়, রয়েছে সে চেষ্টাও। সহজ শর্তে ঋণের পাশাপাশি ইউরোপ অঞ্চলে রপ্তানিকারকরা চান সরকারের প্রণোদনা। তৈরি পোশাক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব খাতের ব্যবসায়ীরাই এসব সুবিধা আদায়ে তৎপর। এসব দাবির পেছনে তাদের যুক্তি রাজনৈতিক অস্থিরতা।
সূত্রমতে, ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা চাইছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি ফোর্সড লোন ও প্যাকিং ক্রেডিটের মতো ঋণগুলো পরিশোধে সময় চান তারা। এছাড়া শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে সমস্যা হলে যেন সহজ শর্তে ঋণ দেয়া হয়, সে দাবিও রয়েছে ব্যবসায়ীদের।
জানতে চাইলে ব্যাংক ও ট্যাক্স-সংক্রান্ত কমিটির প্রধান আবদুস সালাম মুর্শেদী যায়যায়দিনকে বলেন, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে দাবিগুলো করা হয়েছে। ইউরোর অবমূল্যায়নের বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এসব দাবিদাওয়া নিয়ে আজ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম কমানোর আবেদনও করা হবে। খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো এরই মধ্যে নিজেদের আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতির চিত্র তুলে ধরেছেন। চলমান অস্থিরতায় শুধু পোশাক শিল্পের ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের ১৮১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে এ খাতের সংগঠন বিজিএমইএ। তারা বলছে, চলমান পরিস্থিতিতে উৎপাদন কমেছে ২৫-৩০ শতাংশ। কমেছে ক্রয়াদেশও। এ ব্যাপারে আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, সহিংসতার কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে ক্রেতারা বিকল্প গন্তব্যে ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন। ভবিষ্যতে বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যই এসব দাবি তোলা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, এটা ঠিক যে, অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই ক্ষতি হয়েছে। তবে অন্য খাতের তুলনায় রপ্তানি খাতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের নানা রকমের সুবিধা দেয়া আছে। সুবিধা যদি দিতে হয়, প্রকৃতপক্ষে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের দেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, এ দেশে একটি প্রবণতা আছে, একবার সুবিধা দিলে তা আর তুলে নেয়া যায় না। সে ধরনের কিছু যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তিনি প্রশ্ন তোলেন দেড় মাস ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। সার্বিকভাবে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি কম কিন্তু নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি এখনো হয়নি। রপ্তানি খাত এখনো ভালো আছে। রাজস্বের টাকায় প্রণোদনা দেয়ার আগে সব দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করার পরামর্শ দিয়েছেন এ অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, রপ্তানি খাত এমনিতেই সরকারের সর্বোচ্চ সুযোগ নিচ্ছে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের এটিই অসুবিধা কেবলই সুবিধা চায়। এসব খাতে নগদ সহায়তা অনেক দেয়া হয়েছে। ঢালাওভাবে নগদ সহায়তা না দিয়ে প্রকৃতপক্ষে যেসব ছোট কারখানা ক্ষতির মুখে পড়েছে তাদের চিহ্নিত করে কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়া যেতে পারে। তবে শর্ত থাকবে ওইসব কারখানা কমপ্লায়েন্স এবং মজুরি ঠিকমতো দেয়া হচ্ছে কিনা। নগদ নিয়ে যারা রুগ্ণ কারখানা চালাবে, তাদের টাকা দেয়া যাবে না।
সরকারের নানা ধরনের সুবিধা : পোশাক খাতের জন্য রয়েছে সরকারের নানা ধরনের সুবিধা। কাঁচামাল আনা থেকে শুরু করে রপ্তানি পর্যন্ত, প্রতিটি পর্যায়েই এই খাতকে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। অথচ বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক খাতে যেসব বড় ও দেশজুড়ে আলোড়িত অনিয়ম-জালিয়াতি হয়েছে, তার বেশিরভাগই করা হয়েছে পোশাক খাতকে দেয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা অপব্যবহার করে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতা হলমার্ক গ্রুপও এভাবেই অর্থ জালিয়াতি করেছে। যদিও রপ্তানিতে দ্রুত প্রসারের কারণে হলমার্ককে পুরস্কারও দিয়েছে বিজিএমইএ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে রপ্তানির কাজ পেলে এখন আর তেমন কোনো অর্থেরই প্রয়োজন হয় না পোশাকশিল্প মালিকদের। ব্যাংকই সব ব্যবস্থা করে দেয়। যেমন বিদেশ থেকে কাপড় বা সুতা আনতে অথবা দেশের মধ্য থেকে তা সংগ্রহ করতে ‘ব্যাক টু ব্যাক এলসি’ অথবা স্থানীয় ঋণপত্রের অর্থ ব্যাংকই জোগায়। আনুষঙ্গিক উপকরণ (এক্সেসরিজ) আনতে মাত্র ৭ শতাংশ সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ পান পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। আবার ইসিসি বা এক্সপোর্ট ক্যাশ ক্রেডিটের (রপ্তানির জন্য নগদ ঋণ) নামে এলে শ্রমিকের মজুরির অর্থও দেয় ব্যাংক। ব্যাক টু ব্যাক ও ইসিসির সুদের হার ১৩ শতাংশ। দেশের অন্য কোনো খাতের উদ্যোক্তাদের এই ঋণ নিতে সুদ দিতে হয় অনেক বেশি। উৎপাদন খাতের বাইরে সুদ দিতে হয়ে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত। এর বাইরে বন্ড-সুবিধা তো রয়েছেই।
একমাত্র পোশাক খাতের জন্যই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে কোনো এককালীন জমা (ডাউন পেমেন্ট) নেয়া হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ছাড় দিয়েছে। কেবল তা-ই নয়, পোশাক খাতের ২৭০টি রুগ্ণ শিল্পের আসল ঋণ ও সুদ মওকুফ এবং ঋণকে বস্নক (একটি হিসাবে রেখে) করে রেখে নতুন সুবিধা দেয়া হয়েছে।