Published in মানবজমিন on Tuesday 11 June 2019
জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের মতে, ‘জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে, এরপর তৈরি হয় উপলব্ধি আর তা শেষ হয় যুক্তি দিয়ে। যুক্তির ঊর্ধ্বে কিছুই নেই’। গত আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে আমি জাতীয় বাজেট বিশ্লেষণে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছি। আর তা করতে গিয়ে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অনেক যুক্তিযুক্ত বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তবে সাধারণত: সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে তেমন যৌক্তিক সাড়া পাইনি। এবার দুই ধাপ (কান্টের মতে) পিছিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি মানুষের ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপ্ত করলে যোগাযোগ আরও কার্যকর হয় কি না, তা বোঝার জন্য।
প্রাত্যহিক জীবনে পঞ্চ ইন্দ্রিয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের সার্বিক উপলব্ধি তৈরিতে একটি ইন্দ্রিয় অন্যটির ওপর নির্ভরশীল।
পঞ্চ ইন্দ্রিয়গুলোর অনুক্রমের সমানুতার বিষয়ে কোনো সর্বসম্মত মতামত না থাকলেও, দর্শনেন্দ্রিয় বা চক্ষু সর্বোচ্চে অবস্থান করে।
তাই প্রথমেই দেখা যাক, জাতীয় বাজেট নিয়ে আমাদের দর্শনেন্দ্রিয় কি বলে? আমি মনে করি, এটা হলো জাতীয় বাজেটের আর্থিক কাঠামো। যা নির্ধারিত হয় সরকারের আয়, ব্যয় ও ঘাটতির ওপর ভিত্তি করে। গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখলেও, পদ্ধতিগতভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর ও কর-বহির্ভূত রাজস্ব সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছে। জিডিপির অনুপাতে দেশের মোট রাজস্বের পরিমান বিশ্বে সর্বনিম্ন দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম! উপরন্তু, প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ মোট রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ মাত্র এবং এই কর আদায়ের গতি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ভ্যাট সংক্রান্ত নতুন আইনের কার্যকর প্রয়োগ অবশ্যই এক্ষেত্রে একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে যোগ হবে।
এ অবস্থায় নিজস্ব উদ্বৃত্ত রাজস্ব দ্বারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অর্থায়ন সরকারের পক্ষে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। সৌভাগ্যক্রমে, এডিপি বাস্তবায়ন এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার নিচে রয়েছে। ফলে বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এডিপির আওতাধীন প্রকল্পগুলোর গুণগত মান ও বাস্তবায়ন প্রতি বছরই আমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে। বর্তমানে, বেতন ও ভাতা খাতে সরকারের ব্যয় পৌনপুনিকভাবে অন্যান্য খাতের চেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে বাজেট ঘাটতি কীভাবে সামাল দেওয়া হয়? সরকার প্রতি বছরই অভ্যন্তরীণ ঋণের জন্য উচ্চ সুদের সঞ্চয়পত্র এবং উচ্চ সুদের বৈদেশিক ঋণের দ্বারস্থ হচ্ছে, যদিও বিদেশি অনুদান ও অল্প সুদে ঋণ নেওয়ার সুযোগ বিদ্যমান। সরকারের ঋণের বোঝা যে বাড়ছে তার প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তাই এটা পরিষ্কার যে দীর্ঘ মেয়াদে জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য যে শক্তিশালী আর্থিক কাঠামো দরকার তা ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই আগামী বাজেটে আর্থিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার জন্য সরকার বিশ্বাসযোগ্য কী প্রস্তাব দেয়, আমরা তা দেখার অপেক্ষায় আছি।
আসন্ন বাজেটকে অনুধাবনের জন্য আমি দ্বিতীয় যে ইন্দ্রিয়ের কথা বলবো তা হলো- সাউন্ড বা শব্দ। যদিও এক্ষেত্রে সাউন্ড বা শব্দের অর্থ হলো কোলাহল, মিউজিক বা সংগীত নয়। আর ব্যাংকিং খাত এবং পুঁজিবাজার থেকে সৃষ্টি হচ্ছে উচ্চস্বরের সেই কোলাহল। ডেব্ট মার্কেট বা ঋণবাজার এবং ইকুইটি মার্কেট উভয়েই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় রয়েছে যা আভ্যন্তরীণ পর্যায়ে বেসরকারি বিনিয়োগে হতাশাজনক পারফরমেন্সের ক্ষেত্রে প্রধান কারণগুলোর অন্যতম। গত চার বছর ধরে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে বেসরকারি বিনিয়োগের হার স্থবির হয়ে আছে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের চিত্রও নিষ্প্রভ। ক্রমবর্ধমান ঋণ খেলাপির মধ্যেও সম্প্রতি সুদের হার নিয়ে সরকার যে নয়-ছয় করলো, তাতে এই খাতের মূল সমস্যা, ত্রুটিপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা মোকাবেলা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে, প্রথাগত আর্থিক প্রণোদনার বাইরে, আসন্ন বাজেটে সরকার নীতিগত কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা আমরা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
দর্শন ও শ্রবণেন্দ্রিয়ের আপেক্ষিক গুরুত্বের বিপরীতে, অবশিষ্ট তিনটি ইন্দ্রিয়- যেমন স্পর্শ, স্বাদ ও ঘ্রাণের ক্রম সর্ম্পকে (গুরুত্বের বিবেচনায়) সর্বসম্মত কোন মতামত নেই। যাহোক, আমি উপরে উল্লিখিত ক্রম অনুসারেই বলছি।
আগামী বাজেটে যে খাতে সরকারের সূক্ষ্ম স্পর্শের প্রয়োজন তা হলো বহির্খাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ থাকা সত্ত্বেও আমদানির উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। সরকারের লেনদেনের ভারসাম্য ও চলতি হিসাব উভয়ই নিম্নগামী। আর আগেও বলেছি, সরকারের ঋণভার যে বাড়ছে তার পূর্বলক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ার লক্ষণও পরিষ্কার। সে জন্য টাকার বিনিময় হার চাপের মুখে আছে। মুদ্রা অবমূল্যায়নেরও প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতির চিন্তা করে সরকার টাকার মান না কমিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশি ও রপ্তানিকারকদের আর্থিক প্রণোদনা দিতে পারে। ব্যাপারটা হলো, ব্যালান্স অব পেমেন্ট নিয়ে যে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে তাতে সরকারকে সূক্ষভাবে মোকাবেলা করতে হবে। বাজেটে সরকার এই বিষয়ে কী নীতি গ্রহণ করে তার মধ্য দিয়েই স্পর্শেন্দ্রিয়ের ব্যাপারটা বোঝা যাবে।
উৎপাদনশীল খাতের জন্য সরকার কী প্রস্তাব পেশ করে তার মধ্য দিয়েই আগামী বাজেটের স্বাদ বোঝা যাবে; বিশেষ করে দেশীয় বাজারভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার কী উদ্যোগ নেয়, তা দেখে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। চলতি বছরে দুটি বিষয় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। প্রথমত, পাট খাতের দুরাবস্থার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্থিতিশীল অবস্থার প্রকাশ পেয়েছে। এক্ষেত্রে, আসন্ন বাজেট কি পুঁজি সরবরাহের বাইরে উদ্ভাবনী কোন কর্মসূচী প্রস্তাব করবে? দ্বিতীয়ত, অতি অবহেলিত কৃষি খাত, যেখানে কৃষকেরা ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাদের জন্য সরকার কী করে। এখানেও নতুনত্বের দরকার। বিপুল পরিমানে ও অধিক কার্যকরভাবে ধান কেনার প্রতিশ্রুতির বাইরেও বাজেটে কি বাজার ব্যবস্থা কৃষকের অনুকূলে আনার কোনো কার্যকর প্রস্তাব দেয়া হবে?
পরিশেষে আসা যাক, সর্বশেষ ইন্দ্রিয়ে। আগামী বাজেট কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় তা দিয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে বাজেট সুগন্ধ না কটু গন্ধযুক্ত। সামগ্রিক মানব উন্নয়ন সূচকের প্রেক্ষাপটে প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব। এছাড়াও আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়ে চলছে, যার ফলাফল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার ঘাটতিতে সুস্পষ্ট। এখন দেখার বিষয়, স্বাস্থ্য বাজেট জিডিপির ১ শতাংশ ও শিক্ষা বাজেট জিডিপির ২ শতাংশের কোটা থেকে বেরোতে পারে কিনা? সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কোন অগ্রগতি হয় কি না, অনেকে আবার তাও দেখতে চাইবেন।
দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান নানা চ্যালেঞ্জের কারণে আমাদের উচ্চ মধ্যম-আয়ের দেশ হওয়ার যাত্রাপথ বন্ধুর হয়ে যেতে পারে, মসৃণ ও টেকসই উত্তরণ ব্যাহত হতে পারে। এমনকি পঞ্চেন্দ্রিয়-নির্ভর একটি জাতীয় বাজেটের পক্ষেও তা করা সম্ভব হবে না, যদিও অনেকে এ নিয়ে আমার সঙ্গে তর্ক করতে পারেন। পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে যা অনুভব করছি তার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, আমাদের ব্যাপক সংস্কারের দিকে যেতে হবে। এই অপশাসনের যারা অন্তর্নিহিত সুবিধাভোগী, তাদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে এই সংস্কার প্রয়োজন। এর জন্য, আমাদের নতুন অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে কী ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের’ পরিচয় দেন, তা দেখার জন্য রহস্যোপন্যাস পাঠের মতো অধীর আগ্রহ নিয়ে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি), ঢাকা