Published in প্রথম আলো on Monday, 11 April 2016
প্রথম আলোর গোলটেবিল
কাউকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন নয়
নিজস্ব প্রতিবেদক
গোলটেবিলে আলোচনা করছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। পাশে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী l প্রথম আলোপরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, কাউকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন নয়, কেউ পিছিয়ে থাকবে না। সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। গরিব মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার সব কাজ সরকার একা করতে পারবে না। এ জন্য বেসরকারি সংগঠনগুলোকে প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
গতকাল রোববার প্রথম আলো আয়োজিত ‘সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল ও বাজেট ২০১৬’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে পরিকল্পনামন্ত্রী এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
এ গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করেছে জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা ফোরাম (এনএফএসপি), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও যুক্তরাজ্যের দাতা সংস্থা ডিএফআইডি।
বৈঠকে অনেক বক্তা তৃণমূল পর্যায়ে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো তদারকিতে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের বিস্তৃত সুযোগ তৈরির সুপারিশ করেন। বক্তারা বলেন, শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে প্রসূতি ও শিশুর যত্ন নেওয়া থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত জীবন চক্রভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা কৌশল হওয়া উচিত। এ ছাড়া সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিকে দাতব্য হিসেবে বিবেচনা না করে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। এ জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বেশি বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ করেন তাঁরা।
সামাজিক সুরক্ষায় অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ফাঁকি দিয়ে সব নিয়ে যাচ্ছে, সেই ব্যবস্থা আর নেই। মানুষ সচেতন হয়েছে। এখন ফাঁকি দেওয়া খুব কঠিন। তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে দারিদ্র্য নিরসনের সব প্রকল্পে মানবসম্পদ গঠনে একটি উপখাত রাখা হচ্ছে। গরিব মানুষকে পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি।’
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘হাওর অঞ্চলের দুই কোটি মানুষকে বাইরে রেখে কি উন্নয়ন হবে?’ বক্তব্যের একপর্যায়ে বেদে, জেলে, কামার-কুমার, তাঁতিসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রকল্প নিয়ে আসার জন্য বেসরকারি খাতের প্রতি আহ্বান জানান পরিকল্পনামন্ত্রী। এ সময় বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা ফোরামের (এনএফএসপি) আহ্বায়ক রাশেদা কে চৌধূরী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘মিড ডে মিল’ চালুর সুপারিশ করেন। পরিকল্পনামন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে মিড ডে মিল চালুর আশ্বাস দেন।
বৈঠকে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো তদারকির জন্য সুশীল সমাজকে সম্পৃক্ত করা হলে সরকারের হাতই শক্তিশালী হবে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনে প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল প্রথম আলো ও জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা ফোরামের উদ্যোগে আয়োজিত ‘সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল ও বাজেট ২০১৬’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা l ছবি: প্রথম আলোএনএফএসপির কো-কনভেনর ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক তোফায়েল আহমেদ বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কৌশল জীবন চক্রভিত্তিক হওয়া উচিত। তিনি বলেন, শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশনের জন্য বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। এ জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল অন্যায় নয়, যদি সবার জন্য পেনশন থাকত। তিনি মনে করেন, যাঁরা কর দেন, তাঁদের জন্য সীমিত পরিসরে হলেও পেনশনের ব্যবস্থা করা উচিত।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ। তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তায় শুধু মোট ব্যয় বাড়ালেই হবে না, দরিদ্রদের পক্ষে ব্যয় বাড়াতে হবে। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বাজেটের অভ্যন্তরেও ব্যয় বিন্যাস বদলানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, তৃণমূল থেকে নির্বাচিত সুবিধাভোগীর তালিকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে গেলে যেন কারও নাম কেটে দেওয়া না হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ শুধু তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত বা সংশোধন করতে পারবে, পরে তা তৃণমূল পর্যায়ে বা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির অনুমোদন নিতে হবে।
মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, বর্তমানে দারিদ্র্য আয় রেখার নিচে বসবাসকারী লোকের স্বীকৃত ন্যূনতম সংখ্যা ৪ কোটি। দারিদ্র্য রেখার ঊর্ধ্বে কিন্তু খুব বেশি ঊর্ধ্বে নয় এবং যেকোনো সময় ধাক্কা খেয়ে নিচে নেমে যেতে পারে, এমন নাজুক দরিদ্রদের সংখ্যা যোগ করলে মোট সংখ্যা ৮ থেকে ১১ কোটি হতে পারে।
এনএফএসপির কো-কনভেনর ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, সরকার যে সুরক্ষা কৌশল নিয়েছে, এর ব্যবস্থাপনা যেন ভালো হয়। অধিক সংখ্যক মানুষ যাতে এতে সুবিধা পান। নাগরিকদের পক্ষ থেকে তৃণমূল থেকে মানুষের চাহিদা তুলে এনে তা নির্ধারকদের সামনে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অতিদরিদ্র মানুষকে আরেক ধাপ উত্তরণ করতে হবে। তবে কিছু ক্ষেত্রে যেমন বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা—এ ধরনের সুরক্ষা কর্মসূচি সব সময়ই লাগবে।
বেসরকারি সংস্থা এডিডি ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর শফিকুল ইসলামের মতে, সামাজিক সুরক্ষায় সুবিধাভোগী নির্বাচন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মুক্ত অবস্থায় হচ্ছে না। সামাজিক সুরক্ষার জন্য ২৩টি মন্ত্রণালয়ের ১৪৫টি কর্মসূচি দরকার আছে কি না—সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।
স্বচ্ছতার সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রকৃত সুবিধাভোগী চিহ্নিত করার সুপারিশ করেন কারিতাস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক বেনেডিক্ট আলো ডি রোজারিও।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ শতাংশের সমপরিমাণ উন্নীত করার সুপারিশ করেন ডিএফআইডির দারিদ্র্য ও সামাজিক নিরাপত্তা উপদেষ্টা নাভেদ চৌধুরী।
ইউএনডিপির জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি উপদেষ্টা গোরান জনসন বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্রে খাতওয়ারি বরাদ্দ এবং মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর আওতায় বরাদ্দের তথ্যের মধ্যে বেশ ফারাক আছে। সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দকে ‘ব্যয়’ হিসেবে না দেখে ‘বিনিয়োগ’ হিসেবে দেখার পরামর্শ দেন তিনি।
বরাদ্দ দেওয়ার সময় দারিদ্র্য ‘পকেট’গুলোর দিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দেন ইউএনডিপির অ্যাসিস্ট্যান্ট কান্ট্রি ডিরেক্টর পলাশ কান্তি দাস। একই পরামর্শ দেন এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথের নির্বাহী পরিচালক এস এম এ রশিদ।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) উপপ্রধান ফায়জুল ইসলাম বলেন, অনানুষ্ঠানিক খাতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সুরক্ষা নেই। তাই শ্রম আইনে অনানুষ্ঠানিক খাতের বিষয়ে সংজ্ঞায়িত করা উচিত।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান জানান, জিডিপির ২ দশমিক ২ শতাংশের মতো অর্থ ব্যয় হয় সামাজিক নিরাপত্তায়। এ অর্থের ২৭ শতাংশই ব্যয় হয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন হিসেবে। এ অর্থ বাদ দিলে জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশের মতো অর্থ ব্যয় হয় সামাজিক নিরাপত্তায়।
অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসের জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি ব্যবস্থাপক শ্বাশতি বিপ্লব বলেন, সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি দক্ষতাও বাড়াতে হবে। মাছ না দিয়ে মাছ ধরার কৌশল শিখিয়ে দিতে হবে, যাতে সারা জীবন চলতে পারে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ঊর্ধ্বতন কর্মসূচি কর্মকর্তা আরেফিন আক্তার বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, প্রসূতিকে দেওয়া ভাতা পরিবারের অন্য প্রয়োজনে কিংবা ব্যবসায় সেই অর্থ খরচ হচ্ছে। যে উদ্দেশ্যে ভাতা দেওয়া হচ্ছে, সেই উদ্দেশ্যে খরচের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির সুপারিশ করেন তিনি।