সবুক্তগীন
‘ওমুয়ামুয়া’র চুপিচুপি আগমন, পৃথিবীর খুব কাছেদিয়ে অতিক্রম (মাত্র ১৫ মিলিয়ন মাইল দূরত্বে) আর অপ্রত্যাশিত অতি সামান্য দিক ও গতি পরিবর্তন করে, ধারনার চেয়ে অতি দ্রুত প্রস্তান -মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মাঝে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং খুলে দিয়েছে গবেষণার নতুন নতুন দিগন্ত।
ওমুয়ামুয়া – আসলে কি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে বিজ্ঞানীদের কিছু সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এটা না ধুমকেতু -কেননা এটার লেজ নেই, নেই কোনও জ্বালানি এবং এটা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে না। এটা না উল্কা পিণ্ড- কেননা এটা মঙ্গল গ্রহ আর বৃহস্পতি গ্রহের মাঝখানের ‘Asteroid Belt’ থেকে সৃষ্টি হয়নি। এটার আকার, চেনা জানা মহাকাশিয় বস্তুর চেয়ে ভিন্ন- মোটেও গোলাকার নয় বরং লম্বাটে। প্রায় ২০০ মিটার লম্বা- সিগারেট আকৃতি। এর ঘনত্ব অনেক কম। এটার চলন বড়ই অদ্ভুত । এটা অক্ষের উপর ঘুরে, ডিগবাজী খায় আবার কেঁপে কেঁপে খুব দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। অনেক গবেষক তাই এটাকে অন্য মহাবিশ্ব থেকে আগত কোনও মহাকাশ যান বলেও আশংকা করেছিলেন। তবে এখন ডাটা উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলেছেন- এটা মহাকাশ যান হতে পাড়ত -তবে নয়। কেননা এটা কোনও ধরনের ডাটা পাঠাতে চেষ্টা করেনি বা একেবারে চুপটি মেরে থেকেছে।
ওমুয়ামুয়া (Omuamua)– এই সৌরজগতের বাইরে থেকে আসা এক আগুন্তক। ওমুয়ামুয়া শব্দের মানে পরিব্রাজক বা অনেক দূর থেকে আসা অপরিচিত কেউ। এই নাম করনটি করা হয়েছে হাওয়াই এর আদিবাসীদের ভাসা থেকে, যদিও প্রথম প্রথম এটার নাম দেয়া হয়েছিল ‘রামা’। এটা প্রথমে নজরে আসে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখে-হাওয়াই এর ‘হালিয়াকালা অবসারভেটরিতে’- যখন এটা সূর্যের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল- ১৯৬,০০০ মাইল প্রতি ঘণ্টা গতিতে। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা ১৯৭০ সাল থেকে এইরকম এক আগুন্তকের খোঁজে রাতের পর রাত কাটিয়েছেন। কিন্তু এমনটি আর দেখেননি। হওয়াটা খুব সহজ ও নয়। কেননা নিকটবর্তী সৌরজগতটি ৪.৪ আলক বর্ষ দূরে আর সেখান থেকে কোন বস্তুর এই সৌর জগতে আসতে কম করে হলেও ৫০,০০০ বছর লাগার কথা।
এর আগমন বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যপক আগ্রহের জন্ম দেয়। কেননা এর উৎস, গঠন, গতিপথ বা গন্তব্য সম্পর্কে ধারনা করতে পারলে অনেক লাভবান হবে বৈশ্বিক মহাকাশ বিজ্ঞান। কিন্তু সময় ছিল খুব স্বল্প। শুধু তাই না, এটা সামান্য হলেও গতি পথ পরিবর্তন করে এবং প্রত্যাশার চেয়ে বেশী গতিতে চলতে শুরু করে। হার্ভার্ডের দুই জন বিজ্ঞানী, বেইলি এবং লোয়েব, ধারনা প্রকাশ করেন যে, এটা একটা মহাকাশ যান হতে পারে যেটি সৌর শক্তিকে ব্যবহার করে চালিত হচ্ছে (Solar sail powered spacecraft)। এর লম্বা আকার, অতি হাল্কা ঘনত্ব, হঠাৎ গতি বৃদ্ধি -এই ধারনাকে কিছুটা হলেও জনপ্রিয়তা দেয়। এমনকি “Astrophysical Review Letters Journal“ এটাকে অতি উন্নত প্রযুক্তির কোন মহাকাশ যান বলে ধারনা দেন – যেটি কিনা পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে উড়ে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে।
সম্মিলিত প্রচেস্তায় বিভিন্ন টেলিস্কোপ ও অবসারভেটরির সাহায্য নিয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত। ফেব্রুয়ারী ২০১৯ পর্যন্ত এটা নেপচুন গ্রহের পাশ দিয়ে বের হয়ে চলে যাচ্ছে। এখন বিজ্ঞানীদের হাতে অনেক বিশ্লেষণ আছে। তারা মোটামুটি একমত যে, এটাই আধুনিক সময়ে অন্য সৌরজগত থেকে আগত একটি মহাকাশিও বস্ত- যেটি অজানা কোন কারনে ছিটকে চলে এসেছে। এখন তাঁরা মোটামুটি নিশ্চিত যে, এটা হয়ত কোন মহাকাশ যান ছিল না, অন্তত সেটা জানার মত প্রযুক্তি আমাদের নেই। এরই মধ্যে আমায়া মারটিন নামক একজন বিজ্ঞানী তাঁর একটি প্রকাশিত লেখায় দাবী করেছেন যে, ওমুয়ামুয়া আসলে ঘনিভুত পানির এক ধরনের কাঠামো। যা বিশেষ পরিবেশে সৌরজগতের বাইরে তৈরি হতে পারে। কিছু বিজ্ঞানী মনে করছেন, তাঁর এই ধারণা- অন্য বেশী গ্রহন যোগ্য ধারনার অভাব পূরণে- গ্রহন যোগ্য হতে পারে। কেননা এই ধারনা, ওমুয়ামুয়ার বিশেষ গড়ন, বিশেষ ভাবে ওজনের স্বল্পতা ও অতি হালকা ঘনত্ব ও লম্বা গড়ন ব্যাখ্যা করতে পাড়ে।
যাইহোক ওমুয়ামুয়া- আমাদের বিশ্বাসকে নাড়া দিয়েছে। এই সৌর জগতে বাহির থেকেও অন্য মহাজাগতিক বস্তু আসতে পারে। যা কিনা আমাদের সপ্নের সৌর জগতকে করতে পারে ভঙ্গুর। ওমুয়ামুয়া, আমাদের জানাচ্ছে যে, মানব জাতিকে আর অনেক পথ পারি দিতে হবে মহাকাশ গবেষণায়।