Published in প্রথম আলো on Thursday, 24 June 2016
যেভাবে পাচার হয়
১০ বছরে পাচার সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা
শওকত হোসেন
১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এই অর্থ এবারের বাজেটের চেয়েও ১ লাখ কোটি টাকা বেশি। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই।
এর বাইরে গত দুই অর্থবছরে সুইস ব্যাংকসমূহে বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। এই অর্থও পাচার করা। আবার মালয়েশিয়ায় ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে গত ১৩ বছরে ৩ হাজার ৬১ জন বাংলাদেশি অর্থ পাঠিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এর চেয়ে বেশি মানুষ গেছে চীন ও জাপান থেকে। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন অসংখ্য বাংলাদেশি।
বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের এসব তথ্য এক জায়গায় নিয়ে এসেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অবৈধ অর্থ পাচার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে টাকা পাচারের পরিসংখ্যানটি নেওয়া হয়েছে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) তৈরি করা একটি গবেষণা থেকে। সিপিডি বলছে, বিভিন্ন ধরনের ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ অন্য দেশে পাঠানো হচ্ছে। বর্তমান সময়ে কেবল বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বেই অর্থ পাচার অন্যতম আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি সময়ে এখান থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ বাড়ে। যেমন, নির্বাচনের প্রাক্কালে টাকা পাচারের পরিমাণ বাড়ে, এ ছাড়া দেশের ভেতরে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা থাকলে এবং বিনিয়োগের সুযোগ না থাকলে তখনো টাকা পাচার বাড়ে। ঘটনাক্রমে এই তিনটি কারণই ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে বিদ্যমান। এ কারণেই অব্যাহতভাবে বছরের পর বছর টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে এ নিয়ে বলেন, কর এড়িয়ে টাকা পাচারকারীদের কোনোভাবেই ছাড় দেবে না এনবিআর। টাকা পাচারকারীদের ধরতে একটি স্থায়ী কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদন বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য রয়েছে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে ২০১২ ও ২০১৩ সালে। এর মধ্যে ২০১৩ সাল ছিল নির্বাচনের আগের বছর। এই সময়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ ছিল ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং ২০১২ সালে পাচার হয়েছে ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ ছাড়া ২০০৪ সালে পাচার হয় ৩৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০০৯ সালে ৬১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং ২০১১ সালে পাচার হয় ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার।
সিপিডির হিসাবে, ২০১৩ সালে পাচার হওয়া অর্থ দেশের শিক্ষা বাজেটের তুলনায় ৩ দশমিক ৬ গুণ বেশি, আর স্বাস্থ্য বাজেটের তুলনায় বেশি ৮ দশমিক ২ গুণ। পাচার হওয়া ওই অর্থের ২৫ শতাংশ হারে যদি কর পাওয়া যেত তাহলে স্বাস্থ্য বাজেট তিন গুণ এবং শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ করা সম্ভব হতো। সিপিডি তুলনা করে আরও দেখিয়েছে, ওই সময়ে পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ওই সময়ে বাংলাদেশের পাওয়া মোট বৈদেশিক সাহায্যের ৩৪০ শতাংশের সমান।
জিএফআইয়ের গবেষণা অনুযায়ী, মোট পাচার হওয়া অর্থের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমদানি করা পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে অর্থ বাইরে পাচার করা হয়। সিপিডি এ বিষয়ে গবেষণা করে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু উদাহরণ দিয়েছে। যেমন, ২০১৪ সালের মার্চে সাড়ে ৫৪ শতাংশ আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা একটি রেকর্ড। এ সময়ে কেবল পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ৭৩ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। আবার এ সময়ে ফ্রান্স থেকে কেবল ক্রেন (পণ্য ওঠানো-নামানোর যন্ত্র) আনা হয়েছে ৪৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের। পুঁজি যন্ত্রপাতি হিসেবে এর শুল্ক মাত্র ২ শতাংশ। ২০১৫ সালেও পুঁজি যন্ত্রপাতির দাম বেশি দেখানো হয়েছে।
সিপিডির দেওয়া আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে ২০১৩-১৫ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে যত চাল বিদেশ থেকে আনা হয়েছে, তার আমদানি মূল্য ছিল টনপ্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার ডলার। অথচ এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের গড় মূল্য ছিল টনপ্রতি প্রায় ৫০০ ডলার।
সিপিডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের উদ্যোগে তৈরি ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজি)-এর হিসাবও। ২০০৩ সালে ফাঁস করা তথ্য অনুযায়ী, অফসোর ব্যাংকিংয়ের সুবিধা নিয়ে অন্য দেশে ব্যাংক হিসাব খোলার সংখ্যা ৩৪টি। আর চলতি বছর ফাঁস করা পানামা পেপারস অনুযায়ী, বাংলাদেশের নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ২৭টি।
দেশ থেকে নানাভাবে অর্থ পাচারের এই বিষয়টি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নতুন বাজেট বক্তৃতায়ও উল্লেখ করেছেন। ২ জুন দেওয়া বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিদেশে অর্থ পাচার এখন নিয়মিত আন্তর্জাতিক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের অপব্যবহার বন্ধ করে আন্তসীমান্ত কর ফাঁকি রোধকল্পে ইতিমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল কাজ করছে। কিন্তু মনে হচ্ছে যে, এই বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সেই উদ্দেশ্যে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ট্রান্সফার প্রাইসিং, বিদেশি নাগরিকের কাছ থেকে কর আদায় এবং অর্থ পাচারের বিষয়টি বিবেচনার জন্য একটি স্বতন্ত্র ইউনিট জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সৃজন করা হবে।’
এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, টাকা পাচার বন্ধে একটি স্বতন্ত্র ইউনিট করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। ইতিমধ্যে অর্থমন্ত্রীর সামনে এ-সংক্রান্ত উপস্থাপনা দেওয়া হয়েছে। বাজেট পাসের পর একটি ইউনিট স্থাপনের প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
তবে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিয়ে টাকা পাচার বন্ধ করা যাবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিন বলেন, এ জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে যে সমস্ত কারণে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় হয় না, পুঁজিবাজার লুটপাটের কোনো বিচার হয় না, ঠিক একই কারণে টাকা পাচারেরও কোনো সমাধান হবে না। তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, ‘টাকা পাচারের এ বিষয়টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনায় নিতে হবে, অর্থমন্ত্রীকে মন্ত্রিসভায় আলোচনার বিষয় বানাতে হবে এবং সরকারপ্রধানকে সংসদে এর পক্ষে জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন নিতে হবে। এভাবে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া না থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপগুলো কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতাই থেকে যাবে। কারণ, যে ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে আমরা জানি তাঁরা খুবই শক্তিশালী। কেবল প্রশাসনের এর সমাধান করা সম্ভব হবে না।’