লিংকন শহিদ
Email: lincolnsh@yahoo.com
নেপোলিয়ন নাকি ইংরেজদের কোন এক সময় ‘নেশন অফ শপ কিপারস’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। বিষয়টি হয়ত একেবারে অবান্তর ছিল না। সেই সময় অনেক ইংরেজই জীবিকার প্রধান উৎস হিসেবে নির্ভর করত দোকানদারির উপর। এর সামাজিক ও রাজনিতিক কারন ও ছিল। চাকুরী পাওয়া সহজ ছিল না। ভাল চাকুরী পেতে হলে শরীরে নীল রক্ত থাকতে হত, বিশেষ ধর্ম বিশ্বাস অনুসরণ করতে হত, উচ্চ মহলের সুপারিশ লাগতো, কখনও কখনও আবার একটা নির্দিষ্ট বাৎসরিক আয় থাকতে হত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল- রাজশক্তি বিরোধী কোন কর্মে নিয়োজিত থাকতে পারবে না। মানে হল, সম্পূর্ণ ভাবে শাসক গোষ্ঠী অনুরাগী হতে হত। কাজেই অধিকাংশ ইংরেজদের বেঁচে থাকতে হত মুদি দোকান করে, বই-পত্রিকা বেঁচে, টাকা সুদে খাঁটিয়ে বা ধর্ম প্রচার করে। যারা কিছু শিক্ষিত – তারা কৃষিতে বা কারখানায় কাজ না করে- করত দোকানদারী, আর না হলে দেশ ছেড়ে চলে যেতো; ছড়িয়ে পড়ত দেশ থেকে দেশান্তরে।
নেপোলিয়ন এখন ইতিহাস, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বাস্তবতার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে কি? দেশের নানান প্রান্তে ঘুরে, আমার অভিজ্ঞতা হল- বাংলাদেশ ও এখন ‘নেশন অফ শপ কিপারস’ । বিশেষ ভাবে বলতে গেলে শিক্ষিত আর স্বল্প শিক্ষিত মানুষ হচ্ছে- ‘ঔষধ দোকানদার’ বা ‘মুদি দোকানদার’। বাকিরা খুলেছে ‘খাবার দোকান’ বা ‘কসমেটিক আর খেলনার দোকান’। নিম্নমধ্যবিত্ত দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে, এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।
আর বাকিরা, যারা সরকারী চাকুরী পাবার সব যোগ্যতা রাখে,- রাজশক্তি বিরোধী কোন কর্মে নিয়োজিত না, সঠিক রাজনৈতিক বিশ্বাসের অধিকারি, সম্পূর্ণ ভাবে শাসক গোষ্ঠী অনুরাগী, গায়ে নীল রক্ত, যথাযথ সুপারিশ দাখিল করতে সক্ষম এবং চাহিবা মাত্র প্রয়োজনীয় টাকা প্রদান করতে সক্ষম- তারা প্রায় সবাই (সবার কথা কিন্তু বলছি না) চাকুরীর সন্ধানে।
সরকারী চাকুরী তা যত ছোটই হোক- চরম আরাধ্য। চাকুরী এখন সোনার হরিণ। বেতন ভাল, অন্যান্য সুবিধা খুব ভাল, খালি উপরের নির্দেশ মত কাজ করতে পারলেই হল, আইনের কোন বালাই নেই, – যাকে ধরতে বলবে তার উপর ঝাঁপায় পড়তে হবে, মামলা করতে হবে (টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া), রিমান্ডে নিতে হবে- আর যাকে বলবে, তাকে ফাঁসির দড়ি থেকে রেহাই দিতে হবে, দিতে হবে ‘দুর্নীতি মুক্ত’ সনদ। অপূর্ব ব্যবস্থা। দেখুন না, বুদ্ধিমান ছাত্ররা তাই চাকুরিতে ‘কোটা’ পাবার জন্য বা উঠিয়ে দেবার জন্যে কি প্রচেষ্টাটাই না চালিয়ে যাচ্ছে।
যে কোন চাকরী চাই, আর তা ‘কেরানীর’ হলে আরও ভাল। কেননা কেরানীদের শুধু মাছি মারতে পারলেই হয়- কোন দক্ষতা লাগে না। অবশ্য এখন প্রায় সকল পর্যায়ে বড় ছোট কর্মকর্তাগণ ‘মাছি মারা কেরানীর’ চেয়ে বেশী কিছু নন। তাঁদের কোনও দক্ষতার মূল্যায়ন হয় না, লেজুড় বৃত্তিই মুল কাজ। আইন-কানুন নিয়ম নীতির কোনও বালাই নেই। নেই পেশাগত নৈতিকতার কোনও বালাই। নেই শাস্তির ভয়।সব গোপন থাকবে, আছে বিশেষ সুরক্ষা। আর আছে তথ্য প্রকাশ না হবার নানা আইন।
আমাকে অবশ্য একজন কেরানী সতর্ক করে দিলেন। বুঝিয়ে বললেন যে, মাছি মারা সহজ না। এগুলো উড়ন্ত অবস্থায় মারা যায় না। কেবল বসা অবস্থায় চেষ্টা করা যায়। এমন ভাবে, আলতো করে চেপে ধরে, মাছি মারতে হয়- যেন ফাইলে বা কাগজে দাগ না পরে। এটি বিশেষ দক্ষতা। এক ধরণের শিল্প। যারা কেরানীর চাকুরী প্রার্থী তারা সবাই এর রস সম্পর্কে জানেন। সবাই শিল্পরসিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগন পাঁচ-ছ বছর পাঠ্য বই না পড়ে, পড়েন কেবল গাইড বই। দিন রাত গুন গুন- ‘নোয়াখালী জেলার পূর্ব নাম কি ছিল’? ‘বনফুলের আসল নাম কি’? ‘মুক্তিযুদ্ধে কয়টি সেক্টর ছিল’? ইত্যাদি। উদ্দেশ্য ভাল মানের কেরানী হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করা। সেই সব মহান ব্যক্তিবর্গ যারা- দুর্নীতি ঘৃণা করেন, যারা সারাদিন তসবি জপেন- এমনকি তাঁরাও, সন্তান একটি উৎকৃষ্ট মানের ‘মাছি মারা কেরানী’ হতে পারলে, আনান্দঅশ্রু ধরে রাখতে পারেন না।
তবে কি এখন এটা বলা যাবে যে- আমরা বাংলাদেশিরা প্রায় সবাই টিকে থাকার জন্যে -জাতি হিসেবে আসলে ‘মাছি মারা কেরানী’ হবার কৌশল আয়ত্ত করেছি? অথবা হয়ে গেছি ? অথবা হবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি?