Published in কালের কণ্ঠ on Monday, 25 April 2016
বদলে যাচ্ছে পোশাক খাত
এম সায়েম টিপু
একসময় যাঁরা বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে মুখর ছিলেন, এ খাতের অর্জন নিয়ে তাঁরাই এখন প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে নানা আয়োজনে পোশাক খাতের ইতিবাচক পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে বিদেশি কূটনীতিকরা বলেছেন, বিশ্বমানের পোশাক কারখানা আছে বাংলাদেশে। তবে বিশ্ব অঙ্গনে নেই তেমন প্রচারণা। পরপর আগুন ও ভবন ধসে প্রাণহানির ঘটনায় এ দেশের পোশাক খাত নিয়ে যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে তা দূর করার জন্য ইতিবাচক প্রচারের ওপর জোর দিয়েছেন তাঁরা।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ভয়াল স্মৃতির স্মরণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা বলেছেন, বাংলাদেশের কিছু পোশাক কারখানা এখন এতটাই আন্তর্জাতিকমানের যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক কারখানা থেকেও এগিয়ে। ওই রাষ্ট্রদূতরা বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনা না ঘটলে বা নিজ চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতাম না।’
গত শনিবার রাজধানীতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) রানা প্লাজার দুর্ঘটনার তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সংলাপে এমন করেই তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করেন। এ সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, ‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের অনেক উন্নতি হয়েছে। এটা আরো করতে হবে। এ জন্য আমরা সহায়তা করব। এই দেশে অনেক ভালো ভালো কারখানা আছে। এত ভালো কারখানা যে বাংলাদেশে আছে, এই দুর্ঘটনা না ঘটলে হয়তো জানা যেত না।’
নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত লিওনি মার্গারেথা কিউলেনার বলেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের চেয়েও অনেক ভালো ভালো কারখানা রয়েছে। এটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচার পায়নি। নেদারল্যান্ডস এই কাজে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংগঠনটির সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ২৮টি কারখানা আছে ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) পরিবেশগত মানের সনদ পাওয়া। এর মধ্যে লিড সনদের সর্বোচ্চ মান প্লাটিনাম ছয়টি, গোল্ড ১৪টি, সিলভার পাঁচটি এবং তিনটি সার্টিফায়েড লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে একটি ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। এই কারখানা ১১০ নম্বরের মধ্যে ৯০ নম্বর পেয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনো কারখানা এত বেশি নম্বর পাওয়ার ঘটনা বিরল। এ ছাড়া শতাধিক গ্রিন কারখানা ইউএসজিবিসি সনদ পাওয়ার প্রক্রিয়ায়।
জানতে চাইলে বিজিএমইএ পরিচালক ও বিশ্বমানের পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ডিবিএল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতরা সরেজমিনে কারখানা পরিদর্শনের পরই তাঁদের এই ধারণা তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। সুইডেনের রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি আমাদের ডিবিএল গ্রুপের কারখানা পরির্দশনে গিয়ে একই অনুভতি প্রকাশ করেছেন। তাঁর পরামর্শ, এ জন্য এখনই স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেশের তৈরি পোশাক খাতের ব্র্যান্ডিয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে বহির্বিশ্বে প্রচারণায় লবিস্ট নিয়োগ করা যেতে পারে। আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো যা করে থাকে।’
ইপিলিয়ন স্টাইল লিমিটেডের পরিচালক মো. জুনাইয়েদ আবু সালেহ মুসা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আমাদের দেশের কারখানাগুলোতে অনেক কাজ হয়েছে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স পরিদর্শনে এই অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়েছে। এ ছাড়া বিজিএমইএর উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা কারখানা পরিদর্শনের ফলে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো দৃশ্যমান হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক প্রচারণায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে।’ তিনি বলেন, ‘বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ইতিবাচক প্রচারণার জন্য যেকোনো উদ্যোগের সঙ্গে থাকব আমরা।’
অটুট থাকবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অঙ্গীকার : এদিকে গত শুক্রবার বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের অগ্রগতির কথা স্বীকার করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ব্রাসেলসে এক বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়, তারা বাংলাদেশের পোশাক খাতের অগ্রগতিতে সম্পৃক্ত থাকবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রতি যে অঙ্গীকার তাদের ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেই অঙ্গীকার অটুট আছে। রানা প্লাজার তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের তিন কমিশনার এক যৌথ বিবৃতিতে এ কথা জানান। তাঁরা বলেন, ‘আজ বাংলাদেশে শ্রমবিষয়ক বেশ কিছু অধিকার দুই বছর আগের চেয়ে অনেক বেশি সুরক্ষিত। ভবন নিরাপত্তা এবং কাজের পরিবেশ অনেক উন্নত হয়েছে।’
চমত্কার অর্জন : এদিকে গতকাল রবিবার রানা প্লাজা দুর্ঘটনার তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বিবৃতিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, ‘তিন বছর আগে রানা প্লাজা ভবনটি ধসের ঘটনায় অনেক শ্রমিক ভবনের নিচে চাপা পড়ে। যারা বেঁচে আছে তাদের জীবন-সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে তাদের দুঃখের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি।’
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘রানা প্লাজার দুঃখজনক ভবন ধস আমাদের সবার ওপর দায়িত্ব বর্তায়। আর সেই দায়িত্ব হলো সম্মিলিতভাবে একটি নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি এবং শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা।’
পোশাক খাতের অগ্রগতির কথা তুলে ধরে মার্শা বার্নিকাট আরো বলেন, ‘গত তিন বছর তিন হাজার ছয় শরও বেশি কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা পরিদর্শন করা হয়েছে এবং ৩৯টি ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দুই শরও বেশি পরিদর্শক নিয়োগ দিয়েছে এবং তাঁদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া হেল্পলাইন চালু, কর্মস্থলের নিরাপত্তার উন্নয়নে বহু পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ছাড়া ৩১টি কারখানা সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠন করা হয়েছে। এসব কিছুই চমত্কার অর্জন, যা জীবন রক্ষা করতে পারে।’
দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে : গতকাল বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক দপ্তরের উন্নয়নমন্ত্রী ডেসমন্ড সোয়েন বলেন, রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প খাতে ব্রিটিশ সরকার যে সহায়তা দেয় তার ফলে গার্মেন্ট কারখানাগুলোর অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। খুশির কথা হচ্ছে, দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শ্রমিক আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে, যাতে শ্রমিকদের আরো বেশি অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া যায়। প্রায় ১০ লাখ শ্রমিককে কারখানা নিরাপত্তার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ৫৮৫টি পরিদর্শকের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, এর মধ্যে ২৭৫টি পদের মধ্যে নিয়োগও দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর এ দেশীয় পরিচালক শ্রীনিবাস রেড্ডি বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এখন নিরাপদ কর্মপরিবেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর এ খাতের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। তবে আরো অনেক পথ বাকি আছে। তিনি বলেন, রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার ভবন, অগ্নি এবং বৈদ্যুতিক নিরাপত্তায় তিন হাজার ৬০২টি কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মাত্র ৩৯টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে।
শুধু বিদেশি সমালোচকরাই নন, এবার দেশি সমালোচনাকারীরাও দিয়েছেন ইতিবাচক স্বীকৃতি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি এবং টিআইবি জানিয়েছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ইতিবাচক দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গত বৃস্পতিবার বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর তৈরি পোশাক খাতের উন্নয়নে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে সেসব খাতের সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে। তবে রানা প্লাজার ঘটনার হোতাদের বিচার না হলে এই অগ্রগতি হবে অর্থহীন।