Published in Daily Shokaler Khabor on Wednesday, 29 January 2014.
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বঞ্চিত সব সুবিধাই বড়দের
সহিংসতার ক্ষতি পোষাতে সহায়তা
এসএম আলমগীর: গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা-সহিংসতার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির সব খাতেই। চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ছোট, মাঝারি এবং বড় সব শ্রেণির উদ্যোক্তা। এই আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখন সরকার উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। তবে সরকারি এসব সুবিধা সবই পাচ্ছেন বড় উদ্যোক্তারা। বঞ্চিত হচ্ছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।
শীর্ষ রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে। বৈঠক করেছেন এফবিসিসিআই, ডিসিসিআইসহ অন্য ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারাও। এসব বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতারা উেস কর কমানো, বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন, বিনিময় হারের ওপর সুবিধা, শুল্ক সুবিধা, টার্ম ঋণ, প্রজেক্ট ঋণ, এলটিআর, এমপিআই, ফোর্স ঋণের বিপরীতে আগামী দু’বছরে সুদ সুবিধা, টেক্সটাইল, গার্মেন্ট, ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজের ঋণ আগামী দু’বছর শ্রেণিকৃত না করা, এলসি খোলাসহ কারখানার অন্যান্য সুবিধা নিরবচ্ছিন্নভাবে দিতে ও ব্লক ইনস্টলমেন্ট দু’বছর করার দাবি জানানো হয়েছে। ব্যবসায়ীদের এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ইতোমধ্যে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যবসার জন্য উেস কর ০.৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৩ শতাংশ করেছে। এছাড়া উদ্যোক্তাদের সুবিধা দেওয়ার জন্য এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) আওতা বাড়ানো হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডাউন পেমেন্ট ছাড়া ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য কেস টু কেস ভিত্তিতে দেখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, ১০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পণ্য রফতানিতে ৫ শতাংশ হারে ক্যাশ ইনসেনটিভ দেওয়া হবে, এক্সপোর্ট লোনের ওপর ৩ শতাংশ সাবসিডি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্যান্য দাবি-দাওয়ার মধ্যে আরও বেশকিছু বাস্তবায়নের পথে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান সকালের খবরকে বলেন, সরকার থেকে এখনও পর্যন্ত যেসব সুবিধার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তার প্রায় সবই রফতানি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতায় দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকেই একেবারে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছেন। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান আরও বলেছেন, রাজনৈতিক সহিংসতায় কৃষি, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতের ক্ষুদ্র উত্পাদকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রফতানিমুখী শিল্পের চেয়ে দেশীয় বাজারনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এতে এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রফতানিনির্ভর শিল্পে প্রায় ১২ শতাংশ হলেও দেশীয় বাজারনির্ভর শিল্পে প্রবৃদ্ধির এ হার ছিল প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। তাই সরকারের পক্ষ থেকে নীতি-সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত সবার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। যাদের পক্ষে জোরালোভাবে ক্ষতির চিত্র তুলে ধরার শক্তি নেই তাদের কাছেও সরকারের প্রণোদনা পৌঁছে দিতে হবে।
সিপিডির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে দেশে হরতাল, অবরোধ ও রাজনৈতিক সহিংসতায় চার খাতে প্রায় ৪৯ হাজার ১৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগ খাতে ১৬ হাজার ৬৮৯ কোটি, কৃষি ও কৃষিজাত শিল্প খাতে ১৫ হাজার ৮২৯ কোটি, রফতানিমুখী বস্ত্রশিল্পে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি এবং পর্যটন খাতে ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সিপিডির এই হিসাবের বাইরে রয়েছে ক্ষুদ্রা ও মাঝারিসহ অনেক খাত। এর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে প্লাস্টিক খাত। বড়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি মিলে এই খাতের উদ্যোক্তা রয়েছেন ৫ হাজার। অভ্যন্তরীণভাবে বর্তমানে এ খাত ১৮ হাজর কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্য উত্পাদন করে। গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতায় অন্যান্য খাতের মতো এই খাতও চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ খাতের উদ্যোক্তারা তাদের ক্ষতি ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে জানিয়েছেন। কিন্তু এ খাতের উদ্যোক্তারা সরকারের দেওয়া কোনো সুবিধা ভোগ করতে পারছেন না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুত ও রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি (অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা) সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু এতে পোশাক শিল্প কোনো ক্ষতির মুখে পড়েনি, পড়েছে প্লাস্টিক শিল্প। অথচ এখন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সরকার পোশাক রফতানিতে উেস আয়কর কমিয়েছে। আমাদের কথা হল, সরকার পোশাক শিল্প মালিকদের একার জন্য কেন এ সুবিধা দেবে। সবার জন্যই এ সুবিধা দেওয়া দরকার ছিল।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প ইন্ডাস্ট্রিজের কো-অর্ডিনেশন কমিটির আহ্বায়ক মশিউর রহমান বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রায় ৩০ শতাংশ খামার এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ সরকার এখনও পর্যন্ত আমাদের জন্য কোনো রকম সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। তিনি বলেন, গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পোল্ট্রি খাতের ক্ষুদ্রা উদ্যোক্তারা মন্ত্রী বা সরকারের ওপর মহলের লোকদের সঙ্গে দেখাও করতে পারছেন, না তারা তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা বলতেও পারছেন না। এ কারণে তাদের সহযোগিতার জন্য কোনো সাড়াও মিলছে না।
হালকা প্রকৌশল শিল্পে গত কয়েক মাসে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়ে বাংলাদেশ হালকা প্রকৌশল শিল্প সমিতির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, এ খাতের উদ্যোক্তাদের সবাই ক্ষুদ্র। ক্ষয়ক্ষতি পোষাতে সরকার বিভিন্ন সহযোগিতার কথা বললেও আমাদের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো ঘোষণা আসছে না। এ খাতের উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণ কম। এ কারণে আমরা ঋণ পুনঃতফসিল বা অন্য কোনো সুবিধা চাচ্ছি না। আমাদের দরকার কম সুদে ঋণ দেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকে জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকার ৫০০ কোটি কোটি টাকার বিশেষ তহবিল রয়েছে এসএমই উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার জন্য। জাপান সরকার মাত্র ০.০১ শতাংশ সুদে সরকারকে এই টাকা দিয়েছে। অথচ এই ঋণ বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে আমাদের নিতে হচ্ছে ২২ থেকে ২৪ শতাংশ সুদে। আমাদের দাবি, কম সুদে এই ঋণ আমাদের দেওয়া হোক। তাহলে ক্ষতি কাটিয়ে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব।’