Published in মানবজমিন on Thursday, 3 December 2015
মাথাপিছু ৪১২৬ ডলার না হলে মধ্যম আয়ের দেশ হবে না
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে বের হতে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় দরকার ৪,১২৬ ডলার। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলার। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার সীমা ১০৪৬ থেকে ৪,১২৫ ডলার। সে হিসাবে বাংলাদেশ কেবল নিম্নমধ্যম আয়ের ঘরে ঢুকলো। চলতি বছরের ১লা জুলাই বিশ্বব্যাংক এ স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু তাতেই সরকার তরফে বলা হচ্ছে- ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। সরকার সংশ্লিষ্টদের এমন দাবির সঙ্গে এক হতে পারছেন না শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বর্তমান বার্ষিক জাতীয় আয়ের গতি বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ-বিমুখ বেসরকারি খাত, সরকারি ব্যাংকে সীমাহীন অনিয়ম, রাজনৈতিক পূর্বাভাস ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি সরকারের দাবিকে সমর্থন করে না। অর্থনৈতিক বোদ্ধারা মনে করেন, সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ আয়ের মধ্যে তফাত অনেক। জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেখানে ছয়, সাড়ে ছয়ের ঘর থেকে বের হতে পারছে না। সেখানে আশাটা কল্পনার মতো। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, সেভেন প্ল্যান অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের উপরে থাকতে হবে। কিন্তু চলমান প্রক্রিয়া তার পক্ষে জোরালো সমর্থন দেয় না। আশাটা অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রেটিংয়ের শুরু ও শেষের তফাত এত বেশি যে ঘোষিত সময়ে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া দুরূহ হবে। কারণ বর্তমান পরিস্থিতি কোনভাবে অনুকূলে নেই। বিশেষ করে বিনিয়োগ পরিস্থিতি অনেক নাজুক বলে মনে করেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উচ্চ মধ্যম আয়ের শুরুর ধাপ ছুঁতে গেলেও অনেক সময় লাগবে। ধাপটির সীমা হলো ৪,১২৬ ডলার। আর শেষ ধাপ হলো ১২,৭৩৫ ডলার। প্রাথমিক পর্যায়ে যেতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন ১০ শতাংশ। তাতে ২০৩০ সালের আগে কোন মতেই সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
বিশ্বব্যাংক মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করেছে। একটি হচ্ছে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, অন্যটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। বাংলাদেশ এখন থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর ১লা জুলাই বিশ্বব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় অনুসারে দেশগুলোকে ৪টি আয় গ্রুপে ভাগ করে। যাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১০৪৫ ডলার বা তার নিচে, তাদের বলা হয় নিম্ন আয়ের দেশ। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে এ তালিকাতেই ছিল। কোন দেশ নিম্ন আয়ের, আর কোন দেশ উচ্চ বা মধ্যম আয়ের, তা নির্ধারণ করে একমাত্র বিশ্বব্যাংক। মূলত কোন দেশগুলোকে তারা কী ধরনের ঋণ দেবে, সেটা ঠিক করতেই এই শ্রেণীবিন্যাস করা হয়। বিশ্বব্যাংকের পরিমাপ অনুযায়ী, ১,০৪৫ ডলার থেকে ১২,৭৩৫ ডলার পর্যন্ত মাথাপিছু জাতীয় আয় হলে একটি দেশ মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় ঢুকে পড়বে। তবে যেহেতু সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ আয়ের মধ্যে পার্থক্যটি অনেক বড়, তাই মধ্যম আয়কে আবার দুটি উপখাতে ভাগ করেছে বিশ্বব্যাংক। অনেকটা উচ্চ মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্তের মতো। আর এই ভাগ অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় ঢুকেছে।
মূলত ১০৪৬ ডলার থেকে শুরু করে যেসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১২,৭৩৬ ডলার, তারা মধ্যম আয়ের দেশের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে আবার আয় ১০৪৬ ডলার থেকে শুরু করে ৪,১২৫ পর্যন্ত হলে তা হবে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং আয় ৪,১২৬ ডলার থেকে শুরু করে ১২,৭৩৬ ডলার হলে দেশগুলোকে বলা হয় উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। এর চেয়ে বেশি মাথাপিছু জাতীয় আয় হলে সে দেশগুলোকে বলা হয় উচ্চ আয়ের দেশ।
বিশ্বব্যাংক ‘এটলাস মেথড’ নামের বিশেষ এক পদ্ধতিতে মাথাপিছু জাতীয় আয় পরিমাপ করে থাকে। একটি দেশের স্থানীয় মুদ্রায় মোট জাতীয় আয়কে (জিএনআই) মার্কিন ডলারে রূপান্তরিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে তিন বছরের গড় বিনিময় হারকে সমন্বয় করা হয়, যাতে করে আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হারের ওঠানামা সমন্বয় করা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১,৩১৪ ডলার। তবে বিশ্বব্যাংকের পদ্ধতি অনুযায়ী তা এখন ১০৪৫ ডলারকে ছাড়িয়ে গেছে। এ কারণেই নতুন তালিকায় মধ্যম আয়ের দেশ হতে পেরেছে বাংলাদেশ। সরকারের ১০ বছরের প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু হয়েছে কেবল নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ।
৪টি দেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের তালিকায় ঢুকতে পেরেছে। বাংলাদেশ, কেনিয়া, মিয়ানমার ও তাজিকিস্তান। সার্কভুক্ত ভারত ও পাকিস্তান নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে অন্তর্ভুক্ত। সব মিলিয়ে এখন নিম্ন আয়ের দেশ ৩১টি, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ ৫১টি, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ৫৩টি এবং উচ্চ আয়ের দেশ ৮০টি।