Published in Alokito Bangladesh on Saturday, 5 April 2014.
বিদেশি সহায়তার সাতকাহন শেষ
আর কত কাল কত শর্তে আবদ্ধ হবে বাংলাদেশ
জাহিদুল ইসলাম
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বর্ধিত ঋণ সহায়তার (ইসিএফ) আওতায় নেয়া ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের সহায়তা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিলাসী ঋণের মাইলফলক হয়ে থাকবে। মূলত বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সঙ্কটে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারছে না, এমন দেশগুলো এ ঋণ নিয়ে থাকে। এ ঋণের অর্থ কোনো উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা যায় না। স্মরণকালের সর্বোচ্চ রিজার্ভ থাকায় ইসিএফ ঋণের অর্থ কোনো কাজে লাগছে না। অলস বসে থাকলেও ইসিএফ ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। উপরি হিসেবে পরিপালন করতে হচ্ছে সংস্থাটির ডজনখানেক শর্ত। বাজেট ব্যবস্থাপনা, ভর্তুকি প্রত্যাহার, বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানো, সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়নসহ বিভিন্ন শর্ত দিচ্ছে আইএমএফ। পাশাপাশি বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রেও সংস্থাটি শর্ত বেঁধে দিয়েছে। ইসিএফ ঋণের শর্তের কারণে এক বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অনমনীয় ঋণ নিতে পারছে না সরকার। এতে আটকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে রাশিয়ার সঙ্গে ঋণচুক্তি।
নতুন করে ডিএলপির আওতায় বিদেশ থেকে ঋণ নিতে সদস্যদেশগুলোর সীমা বেঁধে দিতে চাইছে সংস্থাটি। আইএমএফের নতুন নীতি অনুযায়ী, মেমোরেন্ডাম অব ইকোনমিক অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল পলিসিস (এমইএফপি) মোতাবেক সংস্থাটিকে তিন ক্যাটাগরিতে ঋণের তথ্যসহ মধ্য মেয়াদের জন্য সম্ভাব্য ঋণ পোর্টফোলিওর তথ্য দিতে হবে। এসব শর্ত মানলেই কেবল ঋণ দেবে সংস্থাটি। দাতা সংস্থার এমন শর্তের কারণে অনেকটাই স্বকীয়তা হারাচ্ছে দেশের অর্থনীতি।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের তহবিল থেকে ঋণ নিতে হলে বরাবরই বিভিন্ন শর্ত মেনে নিতে হয়। এ সংস্থা দুটির চাপে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দারিদ্র্যবিমোচন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার। দাতাদের পরামর্শে দুই মেয়াদে পিআরএসপি প্রণয়ন হলেও তা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া যায়নি।
প্রায় সব দাতা দেশ ও সংস্থা বিদেশি সহায়তা ছাড়ে নানা রকমের শর্ত দিয়ে থাকে। পুঁজিবাজারের আধুনিকায়নে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) চলমান ৩০ কোটি ডলারের প্রকল্পটিতে অর্থছাড়ে জুড়ে দেয়া হয়েছিল ১৪টি শর্ত। ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট না হওয়ায় এ অর্থ ছাড় করছে না সংস্থাটি। তাছাড়া আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়ানোর নামে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, শুল্কায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে থাকে এসব সংস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শর্ত মেনে বিদেশি ঋণ নিলে আমাদের নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কমে যায়। বিদেশি ঋণ নেয়ার আগে অবশ্যই শর্তগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিদেশি সংস্থা অনেক সময় এমন কিছু শর্ত দেয়, যেগুলো আমাদের এমনিতেই পালন করা উচিত। বিশেষ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে কোনো শর্ত থাকলে, তা অবশ্যই ভালো। তবে সরকারের ক্ষমতা খর্ব হয়ে যায়, এমন শর্তও দাতারা অনেক সময় দিয়ে বসে। নিজেদের মতো করে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধা সৃষ্টি করে, এমন শর্ত কখনোই শুভ হয় না।
এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশি উৎস থেকে কত কাল ঋণ নেবে বাংলাদেশ। কত কাল দাতাদের শর্তের কাছে আবদ্ধ থাকবে দেশের অর্থনীতি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে ৬০০ কোটি ডলার প্রতিশ্রুতি সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। চলতি অর্থবছরে মোট ৩৩৭ কোটি ডলার বিদেশি সহায়তা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত সহায়তা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও ঠিক করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ বিভাগটি।
লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩৬৬ কোটি ডলার সহায়তা আসবে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আসবে ৩৮২ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ৪০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে। পরের দুই অর্থবছরে ৪২৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার করে বিদেশি সহায়তা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে বিদেশি সহায়তা এনে অর্থনীতির কতটুকু উন্নতি হয়, এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। মূলত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বাস্তবায়ন করে, এমন দেশগুলোকে পিআরএসপি চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। তবে অর্থের অভাবে বাংলাদেশ এমডিজির অনেক সূচকেই পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে এমডিজি বাস্তবায়নের সময়সীমা শেষ হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ৯টি সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ১০টি সূচকে অর্জন লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ১৫টি সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতি বছর ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার বৈদেশিক সহায়তা প্রয়োজন। তবে বিভিন্ন দাতা দেশ ও উন্নয়ন সংস্থার ছাড় করা বৈদেশিক সহায়তা দেড় কোটি ডলারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এ অবস্থায় বৈদেশিক সহায়তা না বাড়লে এমডিজি অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। এমডিজি বাস্তবায়নে মোট দেশজ আয়ের (জিএনআই) দশকি ৭০ শতাংশ দেয়ার কথা থাকলেও এ অর্থ ছাড় করছে না স্কেনডিনেভিয়ান দেশগুলোর বাইরে আর কেউ।
ইআরডি সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ৮ হাজার ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। এর মধ্যে ছাড় হয়েছে ৫ হাজার ৯৩১ কোটি ডলার। ছাড় হওয়া অর্থের মধ্যে অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে ২ হাজার ৪৬৬ কোটি ডলার। সুদে-আসলে ফেরত দিতে হবে, এমন ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৪৬৫ কোটি ডলার। এ সহায়তায় বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বলে দাবি দাতাদের।
এডিবি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়, সংস্থাটি বাংলাদেশে ৫ হাজার ৬০০ শ্রেণীকক্ষ নির্মাণ করেছে। প্রশিক্ষণ দিয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ১৬৭ শিক্ষককে। তাদের কর্মসূচির ফলে ২১ লাখ ৩৭ হাজার ৯৫৯ শিক্ষার্থী উপকৃত হয়েছে। এডিবি ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়তা করেছে। ১ হাজার ১৭৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন ও ১২ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন নির্মাণ করে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে ১৪ লাখ ৮০ হাজার ৭০০ পরিবারে। তাছাড়া মাইক্রোফিন্যান্সের আওতায় ১৪ লাখ ৬১ হাজার ৬৫৪ পরিবার নিয়ে আসা হয়েছে। ১৭৬ কিলোমিটার এঙ্প্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। জাতীয় হাইওয়ে, জেলা ও থানা পর্যায়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৯১০ কিলোমিটার। রেললাইন নির্মাণ ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে ৬২১ কিলোমিটার। সড়ক প্রকল্পে এডিবির উপকারভোগীর সংখ্যা ১ কোটি ১৫ লাখ ৪৭৬ হাজার ৯০০ জন। তবে বিদেশি ঋণে উন্নয়ন যেমন হচ্ছে, বাড়ছে দায়দেনাও। ইআরডির হিসাবে বাংলাদেশের কাছে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার প্রায় ২ হাজার ২৩৮ কোটি ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ডলার পাওনা রয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৭৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। প্রায় ১৫ কোটি জনসংখ্যার দেশে মাথাপিছু বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৮১১ টাকা। অস্ত্র, বিমান, জ্বালানি তেল ক্রয়, আইএমএফ ঋণ ও বেসরকারি ঋণ বাদ দিয়ে এ হিসাব করা হয়েছে।
প্রতি বছর যে পরিমাণ বিদেশি সহায়তা আসে, তার একটি বড় অংশ যায় ঋণ পরিশোধে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা প্রায় ১৫৭ কোটি ডলার ছাড় করেছে। এ সময় সুদ ও আসল মিলিয়ে দাতাদের ৫৯ কোটি টাকা ৩২ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে সরকার। এর মধ্যে আসল ৪৬ কোটি ৮৫ লাখ ডলার এবং সুদ ১২ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। এ হিসাবে ঋণ সহায়তার ৩৮ শতাংশই চলে গেছে আগের ঋণ পরিশোধে। গত অর্থবছরের একই সময় এ বাবদ ৪৬ কোটি ডলার খরচ হয়েছিল বাংলাদেশের। আবার সময়মতো কাজ করতে না পারলে কমিটমেন্ট ফির নামে দিতে হয় জরিমানা। সাত বছরে ১২৭ কোটি টাকা কমিটমেন্ট দিয়েছে সরকার। এর বাইরে রয়েছে পরামর্শক ফি।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, উন্নয়ন খাতে বিদেশি ঋণের সুদের হার তুলনামূলক কম। স্বল্প সুদে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ পাওয়া গেলে তা অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। তবে দ্বিপক্ষীয় ঋণে দাতাদেশগুলো যে শর্ত দিয়ে থাকে, তার অধিকাংশই দেশের স্বার্থের বাইরে চলে যায়। এ বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।