Published in Banik Barta on Monday, 17 March 2014.
পাচার হচ্ছে ঋণের অর্থ
খান এ মামুন ও সাকিব তনু
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় শিল্পঋণ বিতরণ। বিশেষ করে চলতি মূলধন ঋণ বাড়ে প্রায় ১৯ শতাংশ। এ ঋণের বড় অংশই ব্যয় হয় মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে। এজন্য ঋণপত্র খোলা বেড়েছে ঠিকই; তবে ঘোষণাকৃত পণ্যের বদলে আসছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের ব্লক। চট্টগ্রাম, বেনাপোল ও মংলা শুল্ক গোয়েন্দাদের কায়িক পরীক্ষায় মিলছে খালি কনটেইনারও। এসব ঘটনায় ঋণের অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একসঙ্গে কাজ করছে।
আমদানি দলিলাদিতে ঘোষিত পণ্য না আনায় এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে— এবি অ্যান্ড ডি করপোরেশন, আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড, দাদা ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এসআর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ, এসএল স্টিল এবং এলএসআই, ইয়াসির, মিলন ও সেবা এন্টারপ্রাইজ।
এ প্রসঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক মইনুল খান বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পর তদন্ত চলছে। কয়েকটি চালানও আমরা আটক করেছি।’
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে শিল্পঋণ বিতরণ হয় ৮০ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকার। ২০১২-১৩ অর্থবছরে একই সময়ে তা ছিল ৭১ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ১২ দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি ঋণ বিতরণ হয়। তবে ওই একই সময়ে মেয়াদি ঋণ বিতরণ ১ দশমিক ৭ শতাংশ কমলেও চলতি মূলধন ঋণ বিতরণ বেড়ে যায় ১৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। মূলত জাতীয় নির্বাচনের আগে আগেই ঋণ বিতরণ বেড়ে যায়। এর একটি বড় অংশ মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমাদানির নামে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররাও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাসান জামান বলেন, ‘হঠাৎ করে শিল্পঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এ বিষয়ে এনবিআরের সহযোগিতায় কাজও শুরু হয়েছে।’
ঋণের অর্থ পাচার হওয়া প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রফতানিমুখী শিল্পে প্রবৃদ্ধি ঘটলেও অন্য সব খাত ক্ষতিতে পড়েছে। এ কারণে মেয়াদি ঋণ কমে যাওয়াই স্বাভাবিক। তবে চলতি মূলধন ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ পরিষ্কার নয়। এ সময়ে নতুন বিনিয়োগও তেমন হয়নি। তাই এ ঋণের অর্থ অন্যত্র চলে যেতে পারে।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও মূলধনি যন্ত্রপাতিতে ঋণপত্র খোলা বাড়ে ৬৭ দশমিক ২৩ শতাংশ, শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র বাড়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে আমদানি বাড়লেও শুল্ক আহরণের পরিমাণ বাড়েনি। এনবিআরের পরিসংখ্যান ও গবেষণা বিভাগের হিসাবে, আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমেছে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য ছাড়িয়ে নিতে গত বছরের ১১ নভেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টমসে আমদানি দলিলাদি দাখিল করে গাজীপুরের শ্রীপুর ঠিকানার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান দাদা ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। দলিলাদি অনুযায়ী আরব আমিরাতের গ্রিন প্লানেট জেনারেল ট্রেডিং থেকে আমদানি হওয়ার কথা আড়াই লাখ কেজি রেজিন। কিন্তু আমদানিকারক ১৫ কনটেইনারে এনেছেন সাড়ে ৫ হাজার ব্যাগ পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট।
দাদা ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রতিনিধি রূপসা ট্রেডিং এজেন্সিজ লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. মিজান এ বিষয়ে বলেন, ‘সিমেন্ট আসার বিষয়ে রফতানিকারকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে তারা জানায়, দুবাইয়ে শিপিং এজেন্টের ভুলের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। আমাদের রেজিনের চালান চলে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য এক আমদানিকারকের কাছে। আর তাদের সিমেন্টের চালান দাদা ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে চলে এসেছে চট্টগ্রাম বন্দরে।’
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের এবি অ্যান্ড ডি করপোরেশন ইস্পাতের কাঁচামাল (লিড ইনগট) আমদানির তথ্য দিয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর দলিলাদি দাখিল করে সংশ্লিষ্ট শুল্ক বিভাগে। প্রতিষ্ঠানটির ঋণপত্র (নম্বর: ১৩৩৬/১৩/০১/০৩২৭) খোলা হয়েছে সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখায়। ঘোষণা অনুযায়ী ১০ হাজার কেজি লিড ইনগট আমদানির কথা থাকলেও কনটেইনারে আনা হয়েছে লোহার গুঁড়ো।
চীন থেকে পাঁচ লাখ কেজি সোডা অ্যাশ লাইট (ওয়াশিং প্লান্টে ব্যবহূত) আমদানির ঘোষণা দিয়ে সিমেন্টের ব্লক আনে চট্টগ্রামের ইয়াসির এন্টারপ্রাইজ। গত এপ্রিলে আমদানি করা ২০ কনটেইনারের একটি চালানে এ জালিয়াতি হয় বলে নিশ্চিত করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। পণ্য আমদানি করতে ঋণপত্র খোলা হয় প্রিমিয়ার ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায়, যার নম্বর ২১৫১১৩০১০০০৮।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে এসআর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের চীন থেকে আমদানি করার কথা ছিল ২৫ হাজার কেজি অ্যালুমিনিয়াম ও ওয়েস্ট অ্যান্ড স্ক্র্যাপ। কিন্তু এসেছে কনটেইনারভর্তি ছাই।
চট্টগ্রামের শীতলপুরে অবস্থিত এসএল স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ স্পেন থেকে ছয় কনটেইনারে ১৩৯ টন রি-রোলিং প্লেট আমদানির ঘোষণা দিলেও তার পরিবর্তে খালি কনটেইনার আনার তথ্য পাওয়া গেছে শুল্ক গোয়েন্দা নথিতে।
আমদানির নামে অর্থ পাচার হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পণ্য আমদানির আড়ালে বন্দর দিয়ে মূল্যহীন বস্তু আনার বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমদানিকৃত পণ্যের বিপরীতে রফতানিকারক দেশে উচ্চমূল্য পরিশোধ করা হলেও চালানে পাথর, পাউডার, ক্লিংকার ও সিমেন্টের ব্লক আনার ঘটনা ধরা পড়ছে।
নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল সময়ে চলতি মূলধন ঋণ বাড়ার মাধ্যমে অর্থ অন্য খাতে স্থানান্তর হতে পারে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, এ সময়ে শিল্পে কোনো প্রকৃত বিনিয়োগ হয়নি। তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে মেয়াদি ঋণ কমার মাধ্যমেই।
সহযোগিতা: রাশেদ এইচ চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো