Published in সকালের খবর on Tuesday, 12 July 2016
ইতালির পোশাক বাজার হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা
ইতালির পোশাক বাজার হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কাএসএম আলমগীর: বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ষষ্ঠ বৃহত্তম বাজার ইতালি। সদ্য সমাপ্ত ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্য রফতানি হয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের। একই সঙ্গে পোশাকশিল্পে বিনিয়োগও রয়েছে দেশটির উদ্যোক্তাদের। কিন্তু সম্প্রতি গুলশানের রেস্টুরেন্টে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ৯ ইতালীয় নাগরিক হত্যার ঘটনায় হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে দেশটির বাজার। কেননা ওই ৯ জনের মধ্যে ছয়জনই হচ্ছেন গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এ ঘটনায় ইতালীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ নাগরিকের মধ্যে বাংলাদেশি পণ্যের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে ১২৩ কোটি ৮৭ লাখ ৭০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি করা হয়। আর সদ্য সমাপ্ত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে মাস-এই ১১ মাসেই রফতানি হয়েছে ১২৩ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার ডলারের। দেশটিতে প্রতিবছরই রফতানি বাড়ছে এবং মোট রফতানির প্রায় পাঁচ শতাংশ যাচ্ছে ইতালিতে। এছাড়া ইতালির অনেক উদ্যোক্তা কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাতে। সব মিলে ইতালীয়দের কাছে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ স্থানই ছিল। কিন্তু গুলশান হামলায় ৯ নাগরিক হত্যায় শঙ্কিত ইতালীয় ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন সকালের খবরকে বলেন, বাংলাদেশে ইতালীয়-জাপানি নাগরিক দ্বিতীয়বারের মতো হামলার শিকার হলেন। এতে উভয় দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। উভয় দেশেই প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার করে পণ্য রফতানি করে থাকে বাংলাদেশ। তাছাড়া দেশ দুটি তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য উদীয়মান বাজার। আর ইতালীয় অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশে বায়িং হাউস খুলেছেন। সন্ত্রাসী হামলায় ইতালীয় ছয় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী নিহত হওয়ায় অন্য ব্যবসায়ীরাও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। এছাড়া এ ঘটনায় ইতালীয় বিনিয়োগও কমে যাবে। যেকোনো দেশের ক্রেতার জন্যই এ ঘটনা বড় একটি ধাক্কা। এই ধাক্কা কতটা জোরালো হবে এবং এর প্রভাব কতটা দীর্ঘমেয়াদি হবে সেটা নির্ভর করছে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর। সরকার যদি জোরালো ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারে এবং ক্রেতাদের মনে আস্থা ফেরাতে পারে তাহলে হয়তো দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে না।
গুলশান হামলার পর ইতোমধ্যে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের কাছে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে ই-মেইল করছেন এবং ফোন দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে তাদের যেসব কর্মী রয়েছেন তাদের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাসির সকালের খবরকে বলেন, ক্রেতারা আমাদের কাছে উদ্বেগের কথা জানাচ্ছেন। তবে আমরা তাদের আশ্বস্ত করছি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। তিনি বলেন, ক্রেতাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো সরকারের কাছে তুলে ধরতে আমরা প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তেখা করব এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানাব। আশা করব সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
গুলশান রেস্তোরাঁয় নৃশংসতায় নিহত ৯ ইতালীয় নাগরিকের একজন নাদিয়া বেনেদেত্তি। বিজিএমইএসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ওই রাতে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নাদিয়া তার দেশের অন্য আটজন ক্রেতাকে নিয়ে রাতের খাবারের জন্য গিয়েছিলেন। আর পরের দিন শনিবার সকালেই ফিরে যাওয়ার কথা ইতালিতে। নিহত ৯ জন হলেন-আদেলে পুগলিসি, মার্কো তন্দাত, ক্লদিয়া মারিয়া দ’আন্তোনা, নাদিয়া বেনেদেত্তি, ভিনসেঞ্জো দ’আলেত্রো, মারিয়া রিভোলি, ক্রিস্টিয়ান রোসি, ক্লদিও কাপেলি এবং সিমনা মন্তি।
এদের মধ্যে নাদিয়া বেনেদেত্তির বাংলাদেশে একটি বায়িং হাউস এবং সোয়েটার ফ্যাক্টরি রয়েছে। তিনি গত ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে কাজ করছিলেন। তার বায়িং হাউসের নাম স্টুডিও টেক্স। তিনি ইতালীয় ক্রেতাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। আর গাজীপুরে তার একটি সোয়েটার কারখানা রয়েছে, যার নাম ভেলমন্ট সোয়েটার।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাসির বলেন, আমাদের তৈরি পোশাকের একক দেশ হিসেবে ইতালি ষষ্ঠ বৃহত্তম বাজার। গুলশান হামলার কারণে এই বাজারে পোশাক রফতানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কেননা ওই হামলায় যে ৯ জন ইতালীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে ছয়জন ছিলেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। যারা বাংলাদেশ থেকে সরাসরি পোশাক আমদানি করতেন এবং ঢাকায় তাদের বায়িং হাউস রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ইতালিতে আমরা বছরে ১.২০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করে থাকি। জঙ্গি হামলার কারণে এই রফতানি ধাক্কা খাবে।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ সকালের খবরকে বলেন, নিঃসন্দেহে গুলশান হামলার ঘটনা আমাদের জন্য বড় ধাক্কা। বাংলাদেশি পণ্যের বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে ইতোমধ্যেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ঘটনায় প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে আমরা আশা করছি, গুলশান ঘটনার পর থেকে সরকার এখনও পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো ইতিবাচক। আর সরকারের এই ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে ক্রেতাদের মনে আস্থা ফিরে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। তিনি আরও বলেন, যেহেতু ইতালি বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র এবং দেশটির সঙ্গে আমাদের প্রচুর ব্যবসা রয়েছে, সে কারণে ইতালীয় ক্রেতাদের ও ব্যবসায়ীদের মনে আস্থা ফেরাতেও আমাদের কাজ করতে হবে।