Published in Kaler Kantho on Sunday, 22 June 2014.
বিশেষ সাক্ষাৎকার : ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে কিছু পদক্ষেপ পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন
উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার পরিবর্তে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী (২০১৪-১৫) অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু পদক্ষেপ পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি), বিভিন্ন সুধীসমাজ, বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করছেন। তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে। বিশেষভাবে প্রবৃদ্ধি ও রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, ঘাটতি ও ঋণের পরিমাণসহ আরো কিছু বিষয়ে নতুন হিসাব কষতে হবে। একই সঙ্গে অর্থনীতির গতিশীলতার স্বার্থে অর্থনীতিবহির্ভূত বিষয়গুলোতে দিতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। অন্যথায় শিল্প বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে না বেসরকারি খাত। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন হবে না। আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হবে। ঝুঁকিতে পড়বে সমগ্র অর্থনীতি। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হয়েছিলেন সিপিডির অতিরিক্ত পরিচালক (গবেষণা) ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারজানা লাবনী
কালের কণ্ঠ : আপনার দৃষ্টিতে আগামী (২০১৪-১৫) অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট কেমন হয়েছে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রস্তাবিত বাজেটে অনেক ক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই অনেক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এড়িয়ে গেছেন বর্তমান অর্থনীতির গতিধারা ও অর্থনীতিবহির্ভূত বিষয়গুলো; যেমন রাজনীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার প্রয়োজন ছাড়া বড় করেছেন, প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা, বিনিয়োগ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, ঋণ, ঘাটতিসহ আরো বিভিন্ন বিষয়ে যে হিসাব তিনি করেছেন, তা অর্জন করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাই এসব বিষয় পুনর্বিবেচনায় বাজেট চূড়ান্ত করা উচিত। এতে অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় থাকবে। অর্থবছরের শেষ সময়ে হিসাব মেলাতে কাটছাঁটের প্রয়োজন হবে না।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট। বড় অঙ্কের ঘাটতি অর্থনীতির ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা ঘাটতি। আমাদের মতো দেশের বাজেটে এত বড় ঘাটতি অর্থনীতির সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি। আবার বিদেশি ঋণ, সাহায্য বা অনুদানের নিশ্চয়তাও নেই। অনেক ঋণ, সাহায্য ও অনুদান পাইপলাইনে থাকলেও তা কবে নাগাদ পাওয়া যাবে, তারও সুনির্দিষ্ট তারিখ নেই। অন্যদিকে আগামী অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পে স্কেল বাড়ানোর বিষয়টি রয়েছে। বাড়তি অর্থায়নের প্রয়োজন হবে। এমন পরিস্থিতিতে এত বড় অঙ্কের ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নিতে হবে। চলতি অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে ঋণের চাহিদা না থাকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। আগামী অর্থবছরেও এ ধারা চলমান থাকলে সুদ-ব্যয় বাড়বে। সার্বিক ব্যয়-কাঠামোতে চাপ পড়বে। তাই অর্থায়নের নিশ্চয়তা না নিয়েই বড় অঙ্কের ঘাটতি নির্ধারণ করায় অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে।
কালের কণ্ঠ : প্রস্তাবিত বাজেটের ৬২ শতাংশই আয় ধরা হয়েছে রাজস্ব খাত থেকে। চলতি অর্থবছরে রেকর্ড রাজস্ব ঘাটতি সত্ত্বেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জন্য উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এনবিআরবহির্ভূত খাত থেকেও আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায় কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ে উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও এর ওপর এত নির্ভরশীলতা কতটা বাস্তবসম্মত?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত। সরকারের প্রতি আস্থা না থাকায় বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না তারা। আবাসন খাতের চলমান মন্দা অতিদ্রুত কেটে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। থ্রিজি লাইসেন্স ও মোবাইল ফোন নবায়ন খাতেও চলতিবারের ধারাবাহিকতা আগামী অর্থবছরে থাকবে না। এমন প্রেক্ষাপটে রাজস্ব আদায়ে উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ যুক্তিসংগত নয়। বিশেষভাবে চলতিবারের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে এক লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় এনবিআরের পক্ষে সম্ভব হবে না বলেই আশঙ্কা রয়েছে। এতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়েও সংশয় থাকছে। সরকারের আয় না থাকলে ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হবে। পর্যাপ্ত অর্থায়ন না থাকলে যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হবে, তা অসমাপ্ত থাকবে। কোনো কোনোটি শুরুই করতে পারবে না।
কালের কণ্ঠ : আগামী অর্থবছরে এনবিআরের অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের কৌশলেও আনা হয়েছে নতুন ধারা। আয়কর আদায়ে জোর দেওয়া হয়েছে। বর্তমান ভ্যাট (ভেলু অ্যাডেড ট্যাক্স) আইন ও কাস্টমস অ্যাক্ট বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। নতুন কৌশল বাস্তবায়নে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে কতটা গতিশীলতা আসবে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : প্রথমেই মনে রাখতে হবে, এনবিআর এখনো সম্পূর্ণ অটোমেশনে যেতে পারেনি। আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের আওতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে দপ্তর স্থাপন ও ভ্যাটের পরিধি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতাপূর্ণ ধীরগতির প্রশাসনিকব্যবস্থায় দেশব্যাপী রাজস্ব দপ্তর সম্প্রসারণে ছয় মাস বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে। অর্থ বরাদ্দ, নতুন জনবল নিয়োগ থেকে শুরু করে অনেক বিষয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া রাজস্ব দপ্তর স্থাপনসহ অন্যান্য প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াতেই অর্থবছর পার হবে। আবার ভ্যাটের আওতা বাড়ালেও তা আদায় করবে কে? এনবিআরের বর্তমান লোকবল প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকও নেই। শহরকেন্দ্রিক ভ্যাট আদায়েই এখনো সক্ষম নয় এনবিআর। সেখানে উপজেলা পর্যায়ের দোকান থেকে এনবিআর কর্মকর্তারা হিসাব যাচাই-বাছাই করবেন, এটা বর্তমান বাস্তবতায় অসম্ভব। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে কাস্টমস অ্যাক্ট অনুসরণে শুল্ক-সংক্রান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে, যা বাস্তবায়নে চলতিবারে যেসব খাত থেকে শুল্ক আদায় হতো, তা থেকে আগামীতে আদায় কমবে। তাই সার্বিক বিচারে এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতেই আগামী অর্থবছর কেটে যাবে। আগামী অর্থবছরে নেওয়া কৌশলগুলো ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সফলভাবে বাস্তবায়নের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কোনোভাবেই এত বড় অঙ্কের প্রস্তাবিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা এনবিআর অর্জন করতে পারবে না। চূড়ান্ত বাজেটে এনবিআরের জন্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কমানো না হলে এ বছরের মতো আগামী অর্থবছরেও আবার লক্ষ্যমাত্রা সংশোধনের প্রয়োজন হবে।
কালের কণ্ঠ : চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়েছে। নতুন অনেক পণ্যে ধার্য হয়েছে নতুন ভ্যাট। সাধারণ মানুষের ওপর নতুন এ উদ্যোগের কী প্রভাব পড়বে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : পরোক্ষ কর রাজস্ব আদায়ের নিরাপদ হাতিয়ার। তাই আগামী অর্থবছরে এত বড় অঙ্কের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পরোক্ষ কর হিসেবে ভ্যাটের আওতা বাড়িয়ে নতুনভাবে ভ্যাট আরোপের চেষ্টা করা হয়েছে। এর বিকল্প কিছু এনবিআরের সামনে নেই। এসবই নতুন ভ্যাট আইন অনুসারে গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের প্রভাবে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর আবারও ভ্যাটের আঘাত পড়ল। বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়বে। প্রত্যন্ত এলাকার যেসব দোকানদারের আয় কম, তারাও পর্যায়ক্রমে ভ্যাটের আওতায় আসবে।
কালের কণ্ঠ : অতীতে পরোক্ষ কর আদায়ে গুরুত্ব দেওয়া হলেও আগামী অর্থবছরে প্রত্যক্ষ করেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর সুফল কতখানি পাওয়া যাবে রাজস্ব আদায়ে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : জনসংখ্যাবহুল এ দেশে আরো আগেই প্রত্যক্ষ কর আদায়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। মূলত ধনীরা থাকে আয়করের আওতায়। অন্যদিকে পরোক্ষ কর যত বাড়ানো হবে, ততই সাধারণ জনগণের ওপর এর ভার পড়বে। অতিদরিদ্র মানুষ থেকে দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিকে একই হারে পরোক্ষ কর পরিশোধ করতে হবে। পরোক্ষ কর ছেড়ে প্রত্যক্ষ করে গুরুত্ব দেওয়া হলে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমবে। প্রত্যক্ষ কর আদায়ে যেসব কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে, তা আগামী অর্থবছরে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসব কৌশলের সুফল পাওয়া যাবে। তাই দেরিতে হলেও প্রত্যক্ষ করকে রাজস্ব আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করায় সুফল পড়বে রাজস্ব আদায়ে।
কালের কণ্ঠ : করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি, করপোরেট কর কমানোর দাবি ছিল ব্যবসায়ীদের। প্রস্তাবিত বাজেটে এসব বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপ যৌক্তিক মনে করেন?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। স্বল্প আয়ের মানুষদের করের আওতার বাইরে রাখা উচিত। ধনীদের কাছ থেকে আদায় বাড়াতে আরো জোর দেওয়া উচিত। সার্বিক বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা নির্ধারণ হওয়া উচিত। করপোরেট কর কমানোর প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি না। অনেক দেশের তুলনায় এ হার বাংলাদেশে কম।
কালের কণ্ঠ : অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করা ও আবাসন খাতে ফ্ল্যাট ও প্লট কিনতে সুযোগ রাখা হয়েছে। অথচ অর্থমন্ত্রী বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এসব সুযোগ চূড়ান্ত বাজেটে থাকবে না। সম্প্রতি অর্থপাচার বেড়েছে। অনেকে বলছেন, দেশে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সহজ সুযোগ দেওয়া হলে অর্থপাচার কমবে। আপনার মত কী?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : সৎ ব্যক্তিকে কর দিতে উৎসাহিত করতেই অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ ও সাদা করার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকা উচিত বাজেটে। কালো টাকার মালিককে কিছু জরিমানা দিয়ে অর্থ সাদা করার সুযোগ দেওয়া মানেই হলো অনৈতিক কার্যক্রমকে প্রশ্রয় দেওয়া। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কঠোর প্রয়োগে অর্থপাচার বন্ধ করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : ব্যাংকের মাধ্যমে বাড়িওয়ালাদের ভাড়া আদায়, গ্রিন ট্যাক্স, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সারচার্জ, শ্রমিক উন্নয়ন সারচার্জসহ নতুন অনেক ধারণা আনা হয়েছে আগামী বাজেটে। এসব বিষয়ে আপনার মত কী?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : ২৫ হাজার টাকার বেশি বাড়িভাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রহণের আইনটি অবশ্যই থাকা উচিত। এতে রাজস্ব আদায়ের বড় একটি খাত নজরদারিতে আসবে। গণমাধ্যমের মাধ্যমে এ বিষয়ে জনসমর্থন তৈরি করার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ এ আইনটি বাতিলে সমাজের অনেক অসাধু প্রভাবশালী আগ্রহী হবে। তবে এ আইনটি বাস্তবায়নে এনবিআরকে আরো সক্ষম হতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্প স্থাপন ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা করা যাবে না। তাই গ্রিন ট্যাক্স ধারণা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরোপ করা সারচার্জ কতটা আদায় হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। কারণ দেশে দুই কোটি টাকার ওপরে ধনী ব্যক্তিদের যে সংখ্যা এনবিআর ঘোষণা করে, তার সঙ্গে অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করেন। মোটা দাগে এ হিসাব সঠিক বলে মনে হয় না।
কালের কণ্ঠ : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের ভর্তুকি কমানোর সুপারিশ ছিল বিভিন্ন দাতা সংস্থার। এ সুপারিশ মানতেই প্রস্তাবিত বাজেটে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এতে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকছে। সাধারণ মানুষের ওপর আবারও মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : প্রস্তাবিত বাজেটে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি চলতিবার অর্ধেকের বেশি কমানো হয়েছে। তেলের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর আরো এক ধাপ পড়বে মূল্যস্ফীতির প্রভাব। যাতায়াত খরচ বেড়ে যাবে। ভোক্তা পর্যায়ের চাহিদায় যে টানাপড়েন রয়েছে, তা বাড়বে।
কালের কণ্ঠ : অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রস্তাবকালে বলেন, বিনিয়োগে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ ফিরিয়ে আনাই আগামী অর্থবছরে মূল লক্ষ্য। প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি খাতের জন্য বেশ কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের ফলে শিল্প বিনিয়োগে কতটা আগ্রহী হবে উদ্যোক্তারা?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : কর অবকাশ সুবিধা বাড়ানো, কিছু কাঁচামালের আমদানি শুল্ক কমানোসহ বেশ কিছু প্রস্তাব রয়েছে, যা গ্রহণে উদ্যোক্তারা সুফল পাবেন। বাজেটে উদ্যোক্তাদের যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়। ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তহীনতায় ভুগছেন। অর্থ বিনিয়োগ নিরাপদ মনে করছেন না। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যেও সমঝোতা নেই। তাই বিরাজমান সমস্যাগুলো দূর না হলে আগামী এক সপ্তাহ বা এক বছরেও যত সুবিধাই দেওয়া হোক, কেবল তার জন্য শিল্প বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না বেসরকারি খাত। আবার অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি সংকট দূর করতে প্রস্তাবিত বাজেটে চলতিবারের ধারাবাহিকতায় কাগজ-কলমের বাইরে আসতে পারেনি সরকার।
কালের কণ্ঠ : আগামী অর্থবছরে ৭৭০টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক কমানো হয়েছে। এর কী প্রভাব পড়বে শিল্প খাতে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : যেসব পণ্যের সম্পূরক শুল্ক কমানো হয়েছে, তা কম দামে আমদানি করা যাবে। অথচ এসব পণ্যের অধিকাংশই দেশীয় শিল্প কারখানায় যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে কোনো কোনোটি। তাই প্রস্তাবিত বাজেটের এ পদক্ষেপ দেশীয় শিল্পকে কঠিন প্রতিযোগিতায় ফেলে দেবে। চূড়ান্ত বাজেটে এ প্রস্তাব পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে।
কালের কণ্ঠ : অর্থনীতিবহির্ভূত বিষয় অর্থনীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে অর্থনীতিতে। এ বিষয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা আছে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : এত বড় বাজার পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। সুন্দর ও স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করলেই আহ্বান জানানোর প্রয়োজন হবে না, এমনিতেই শুধু দেশি নয়, বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। তাই সরকারের সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া উচিত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ দিলেই হবে না, প্রকৃত সদিচ্ছা থাকতে হবে। প্রশাসনিক কাঠামোকেও সেভাবে গড়ে তুলতে হবে। চূড়ান্ত বাজেটে এ বিষয়গুলোতে আরো স্বচ্ছতা আনার প্রয়োজন রয়েছে।
কালের কণ্ঠ : প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ পর্যাপ্ত মনে হয়? এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : চলতিবারের তুলনায় প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের হার কম। প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি ও শিক্ষায় যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তা না বাড়ালেও স্বাস্থ্য খাতে চূড়ান্ত বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। তবে কৃষি খাতে কিছু উদ্যোগ ভালো হয়েছে। বিশেষভাবে কৃষি থেকে করমুক্ত আয়সীমা দুই লাখ করা হয়েছে। এ ছাড়া চলতিবারের ভালো কাজগুলো গতিশীল রাখা হয়েছে। তবে কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই প্রস্তাবিত বাজেটে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত বাজেটে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। স্থাস্থ্য খাতে তৃণমূল পর্যায়ে চিকিৎসাসুবিধা পৌঁছানোর মতো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। শুধু প্রতিষ্ঠান আর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, শিক্ষা খাতের মান বৃদ্ধিতে কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়েও প্রস্তাবিত বাজেটে সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : আপনাকেও ধন্যবাদ।