Published in Samakal on Thursday, 1 January 2015.
বিশেষ লেখা: তারুণ্য বদলে দিচ্ছে দেশ
কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম_ এ প্রশ্নম্ন অনেকেই করেন। এক কথায় এর উত্তরে বলা যায়_ ১৯৭১ সালে আমাদের দেশের প্রায় সব মানুষ এমন একটি দেশ চেয়েছিলেন, যা হবে পাকিস্তানের বিপরীত। তাদের বিশ্বাস ছিল, নতুন দেশে বৈষম্য কম হবে।
রেহমান সোবহান
কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম_ এ প্রশ্নম্ন অনেকেই করেন। এক কথায় এর উত্তরে বলা যায়_ ১৯৭১ সালে আমাদের দেশের প্রায় সব মানুষ এমন একটি দেশ চেয়েছিলেন, যা হবে পাকিস্তানের বিপরীত। তাদের বিশ্বাস ছিল, নতুন দেশে বৈষম্য কম হবে। শুধু দুই অঞ্চলের বৈষম্য নয়; পাকিস্তানে ক্ষমতা জনগণের হাতে ছিল না। মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সীমিত ছিল। এ ইতিহাস আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। তবুও আজকে আমরা দেখছি, বাংলাদেশের ভেতরে বৈষম্য বেড়েছে। মুষ্টিমেয় লোকের একটি এলিট গোষ্ঠীর জীবনযাপন ঠিক উন্নত দেশের ধনবানদের মতো বিলাসী। বিপুল সাধারণ জনগোষ্ঠী রয়েছে তার বিপরীতে।তারুণ্য বদলে দিচ্ছে দেশ
তবে এ সময়েও কিন্তু দেশের উন্নতি ঘটেছে। অর্থনীতির ভিত দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের প্রায় চার কোটি ছাত্রছাত্রী এখন স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে। এ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাত প্রায় সমান। মাধ্যমিক শ্রেণীগুলোতে ছাত্রীর সংখ্যাই কিছুটা বেশি। স্কুলের সব ছাত্রছাত্রী বিনামূল্যে পাঠ্যবই পাচ্ছে। দেশে স্বাস্থ্য সুবিধা বেড়েছে। অনেক মানুষ গ্রামে থেকেই সরকারি স্বাস্থ্যসেবা লাভ করছে। সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের সময়ে আমরা যে অবস্থায় ছিলাম, এখন সেখানে নেই। অর্থনীতি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতেও অনেক উন্নতি ঘটেছে।
শিল্পের মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্প যথেষ্ট এগিয়েছে। রফতানি আয়ে এ খাত বিপুল অবদান রাখছে। ৩৫ থেকে ৪০ লাখ শ্রমিক এ শিল্পে কাজ করছে এবং তাদের বেশিরভাগ নারী। বর্তমানে এ খাত থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলারের মতো রফতানি আয় হচ্ছে এবং ২০২১ সালে এ আয় ৩৫-৪০ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। কেউ কেউ মনে করছেন, আয় ৫০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত অর্জন করা সম্ভব।
কেবল তৈরি পোশাক নয়, আরও কয়েক ধরনের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের বিকাশ ঘটছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে শিল্প স্থাপিত হচ্ছে এবং এর অনেকটিই ভালো চলছে।বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। আমরা এখন বলতে পারি, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র বাঙালির উপস্থিতি রয়েছে এবং তারা দেশের সুনাম বাড়াতে সহায়তা করছে। সবচেয়ে বড় উন্নতি করছেন আমাদের মাঠের কৃষক ও ক্ষেতমজুররা। স্বাধীনতার পর তারা কৃষি খাতে উৎপাদন প্রায় চার গুণ বাড়াতে পেরেছেন। ক্ষুদ্রঋণে বিপ্লব ঘটেছে। অন্তত ৩০ লাখ পরিবার এ ঋণ নিয়েছেন। নারীরাই এ ধরনের ঋণের বেশিরভাগ পেয়েছেন। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে এসব পরিবারের সব সমস্যার সমাধান হয়তো করা যায়নি, তবে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নতি যে ঘটেছে_ তা নিয়ে দ্বিমত করা চলে না। এ প্রক্রিয়ায় অনেক নারীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস চলে এসেছে। কেবল ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা নয়, তারা বাইরের কাজও করতে পারেন এবং তাতে সাফল্যও মেলে। এর সঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করা প্রায় ৪০ লাখ মেয়ের বিষয়টি যুক্ত করে দেখুন_ প্রায় বিপ্লব ঘটে গেছে আমাদের চোখের সামনে। যে সমাজে নারী ছিলেন গ্রামের ঘরে বন্দি, তারা এখন শহরে এসেছেন।
প্রকৃতই আমাদের উন্নতি ঘটেছে। আমাদের সামনে নতুন সুযোগ এসেছে। আরও উন্নম্নতির পথে চলতে একটি পর্যায়ে আমরা উপস্থিত হয়েছি।আমাদের সম্ভাবনা অনেক। কৃষক একটু সাহায্য পেলে কত কিছুই না করতে পারেন! আমরা এখন খাদ্যশস্য রফতানির কথা ভাবতে পারছি। আমাদের নারীসমাজ দেশকে এগিয়ে নিতে অনেক কাজ করছে। আমাদের যেসব নাগরিক বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন, তাদের প্রশংসা শুনছি। যেখানেই সুযোগ মিলছে, দেশের মানুষ সেটা কাজে লাগাচ্ছেন। আমাদের ইতিহাসে এন্টারপ্রাইজ, অ্যাডভেঞ্চার ছিল না। নোয়াখালী ও সিলেটের কিছু লোক দেশের বাইরে যেতেন ভাগ্যানুসন্ধানে। অন্যরা গ্রামের গণ্ডিতে থাকতেন। কিন্তু এখন নতুন উদ্যোক্তা সমাজ উঠে আসছে। নতুন পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছেন তারা। গ্গ্নোবাল কানেকটিভিটিতে তারা যুক্ত হচ্ছেন। এর সুফল পাচ্ছে দেশ।
তবে ফের বৈষম্য প্রসঙ্গে বলছি। আমাদের স্বাধীনতার একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল ন্যায়বিচারের সমাজ কায়েম করা। এটা করার জন্য উদ্যোক্তা দরকার, বিনিয়োগ দরকার। দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ প্রমাণ করেছেন যে, সুযোগ পেলে তারা সেটা কাজে লাগান এবং আয় বাড়াতে পারেন। সাধারণ মানুষের এ ক্ষমতা পূর্ণ মাত্রায় কাজে লাগাতে চাই প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা তৈরি করা। এটা করা গেলে আমাদের সামনে অসম্ভব সম্ভাবনা তৈরি হবে। এভাবে সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যও কমানো যাবে।আমাদের দেশে রাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের অনেকে ক্ষমতাকে তাদের সম্পদ বাড়ানোর জন্য কাজে লাগান। ধনীরা রাজনৈতিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে আরও ধনী হতে চান। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে আসছেন। বিভিন্ন শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পদে রাজনীতিকরা নিয়োগ পাচ্ছেন। এভাবে অনেকে ধনসম্পদ বাড়িয়ে নিচ্ছেন।
কিন্তু আমাদের ইতিহাস তো এটা বলে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আমরা পাঠ করেছি। এ থেকে আমরা জানি যে, একটি সাধারণ পরিবার থেকে তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। নিজে কষ্ট করেছেন। স্ত্রী কষ্ট করেছেন। তিনি স্বামীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সামান্য সঞ্চয় তুলে দিয়েছেন। বাবার কাছ থেকে টাকা পেতে কতভাবে বোঝাতে হয়েছে। তিন বেলা খাবার টাকা সব সময় থাকত না। গাড়ি ছিল না। রিকশা, বাস, লঞ্চ বা নৌকায় পুরো দেশ চষে বেড়িয়েছেন। ১৯৭০ সালে সংসদে নির্বাচিতদের বেশির ভাগের গাড়ি ছিল না। শীর্ষ নেতা এবং দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের জীবনযাপনে তেমন পার্থক্য ছিল না। বঙ্গবন্ধুর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। আশা-প্রত্যাশা ছিল। ভাবনায় ছিল দেশ ও জনগণ। এখনকার রাজনীতি সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা যদি বৈষম্য কমাতে পারি, রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়বে। যারা মেহনত করেন, তারা অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছেন। তাদের কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ভালো থাকছে। কিন্তু তাদের দৈনন্দিন জীবনে এর প্রতিফলন তেমন নেই। রাজনীতিতে এবং জাতীয় সংসদে তাদের উপস্থিতিও নেই। দেশের মূল সমস্যা এখানে।
অনেক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অনেক নতুন ব্যবসায়ীকে আমরা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত দেখছি। তাদের অভিনন্দন। ব্যবসায়ের ট্র্যাডিশন ছিল না। এখন কতজনে কত কিছু করছেন! দেশের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু একই সঙ্গে লক্ষ্য করি, জনগণের বড় অংশ যথাযথ সুযোগ পাচ্ছেন না। তারা কাজের উপযুক্ত স্বীকৃতি পাবেন না কেন? আমরা অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে চাই। এটা এখন পর্যন্ত পরিসংখ্যানের বিষয় হয়ে রয়েছে। এ লক্ষ্যে পেঁৗছতে হলে যারা এ ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন, দেশের উন্নতি ও প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছেন_ তাদের কাছে তাদের যা পাওয়া উচিত সেটা পেঁৗছে দিতে হবে। আমরা স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে পেঁৗছাব ৭ বছরে। তখন সবাই যেন বোঝেন যে, তারা কাজের স্বীকৃতি পাচ্ছেন। অবদানের সঙ্গে সুবিধাভোগে যে পার্থক্য, সেটা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে। জনগণের বড় অংশের প্রত্যাশা অপূর্ণ থাকলে এর অবসান ঘটানো যাবে না।
স্বাধীনতার ঊষালগ্নে পশ্চিমা বিশ্বের কেউ কেউ বলেছিলেন, বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারবে না। তবে এটা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা (পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হেনরি কিসিঞ্জারই জোর দিয়ে বলেছেন। তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এর কারণ ছিল, তৎকালীন পাকিস্তানকে সামনে রেখে রিচার্ড নিক্সন এবং হেনরি কিসিঞ্জার তাদের ভূমণ্ডলীয় কৌশল বাস্তবায়ন করতে চেয়েছেন। কিন্তু বিশ্ব কেবল তাদের কথায় চলে না। বাংলাদেশকে বাস্কেট কেস বলা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের তরুণ প্রজন্ম দেখিয়ে দিয়েছে_ এ বক্তব্য ঠিক ছিল না। অর্থনীতিতে দেশ এগিয়ে চলেছে। আমরা শিক্ষায় এগিয়ে গেছি। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে।এখন দুটি বাস্তব সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। দেশের ভেতরে স্কুল-কলেজ বেড়েছে। প্রচুর ছাত্রছাত্রী এবং শহর ও গ্রামের সর্বত্র, তবে মান দুর্বল। তরুণ-তরুণীদেরমানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে হবে। তাদের উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে পারলে কোরিয়া, চীনের পথে এগিয়ে যেতে সমস্যা হবে না। আমাদের সমাজে এখন উদ্যোক্তা প্রচুর। তাদের সামনে অনেক সম্ভাবনা। এটা কাজে লাগাতে পারলে তারা আকাশে উড়তে পারবে।
দ্বিতীয় সমস্যা আমি দেখি উদ্যোক্তাদের ভেতরেই। উদ্যোক্তারা উদ্যমী। কিন্তু কাজ করছেন মূলত নিজের জন্য, পরিবারের জন্য। আত্মকেন্দ্রিকতা কাজ করছে তাদের মধ্যে। সমাজ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন থাকছেন। আরেক দল নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে রাজনীতিকে। নিজে আরও ভালো থাকা, আরও উন্নতি করাই যেন লক্ষ্য। ক্ষমতাকে তারা ব্যবহার করে ব্যক্তিগত লাভের জন্য। দুঃখজনকভাবে তরুণ সমাজের অনেকের মধ্যেও এ প্রবণতা দেখি।কিন্তু আমাদের প্রয়োজন দেশ ও সমাজের জন্য সেরা মেধা, প্রতিভা ও উদ্যম কাজে লাগানো। অনেক অনেক নারী-পুরুষ নিজ নিজ স্থানে থেকে কাজ করছেন। এনজিওগুলোর বিপুল সংখ্যক কর্মী সক্রিয় রয়েছেন। সবার জন্য কাজ করা_ এটাই এখন মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেও এটা নিয়ে আসা চাই_ আমি কেবল নিজের জন্য নই, সমাজের সবার জন্য। সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। একদিনে সবকিছু আমরা পাব না। কিন্তু সুযোগ পেলে দেশের চেহারা আমাদের তরুণ প্রজন্ম বদলে দিতে পারবেই।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান :চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ