Published in Prothom Alo on Sunday, 2 February 2014.
বিশেষ সাক্ষাৎকার: রেহমান সোবহান
সুশীল সমাজের প্রভাব আগের চেয়ে কমেছে
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল কাইয়ুম
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বাংলাদেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। এরপর ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
অধ্যাপক রেহমান সোবহানএ ছাড়া ১৯৯১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। তিনি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন এই স্বনামধন্য ও বরেণ্য অর্থনীতিবিদ।
প্রথম আলো : প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করেন?
রেহমান সোবহান : গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আওয়ামী লীগের ৬৫ বছরের গণতান্ত্রিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে। ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ সেই ১৯৪৯ সাল থেকে প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং অবাধ নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করার মধ্য দিয়ে সব সময় ক্ষমতায় এসেছে। তাদের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি কতটা নষ্ট হয়েছে, সে সম্পর্কে ক্ষমতাসীন জোটের ১৫৩ জন সদস্যের চেয়ে বেশি আর কেউ সচেতন হতে পারেন না, যাঁরা একটিও ভোট না পেয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দশম জাতীয় সংসদের সদস্যের শপথ নিয়েছেন।
প্রথম আলো : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? এ রকম একটি নির্বাচন কি বৈধতা দাবি করতে পারে?
রেহমান সোবহান : ৩০০ জন সাংসদের মধ্যে ১৫৩ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দশম সংসদে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে প্রকাশিত সরকারি হিসাব অনুযায়ী, অবশিষ্ট ১৪৭টি আসনের সদস্যরা ৪০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। এসব সংখ্যার হিসাব এটাই প্রতিষ্ঠা করে যে নিবন্ধিত ভোটারদের মধ্যে আনুমানিক ১৮ শতাংশ নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এ রকম একটি নির্বাচন ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে কোনো অংশেই বেশি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ওই নির্বাচনে ২৬ শতাংশ ভোটার তাঁদের ভোট দিয়েছিলেন বলে সরকারিভাবে জানানো হয়। ১৯৯৬ ও ২০১৪ উভয় নির্বাচনেই বাস্তবতার চেয়ে বেশি ভোট পড়েছে বলে দাবি করা হয়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যুক্তিসংগতভাবেই প্রশ্ন ওঠার কারণে বিএনপি সরকারের বৈধতা মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ওই সরকার তখন সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর বিএনপি সরকার প্রথম দিন থেকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল এবং শাসনকালের মেয়াদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা কোনো উৎসাহ পায়নি। দশম সংসদের সদস্যরা এবং তাঁদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারকে তাদের দুর্বল ম্যান্ডেট নিয়ে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে না এবং মনে হচ্ছে তারা মনে করে যে বিরোধীদের যেকোনো চ্যালেঞ্জকে ব্যর্থ করে দিয়ে টিকে থাকতে পারবে। এ ধরনের মনোভঙ্গির মধ্যে আছে বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত।
প্রথম আলো : আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই পরিস্থিতিকে কীভাবে নেয়? কোনো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে কি?
রেহমান সোবহান : আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ, যদিও সবাই নয়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার ব্যাপারে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ সচিবালয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং এ ধরনের ঘটনার অবসানের আহ্বান জানিয়েছে। তারা গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনী পদ্ধতি প্রণয়নের লক্ষ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে ভারত ও চীনের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বার্তা এসেছে। পাশাপাশি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছ থেকে অভিনন্দন প্রাপ্তির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে কোনো জোরালো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেবে বলে এখন পর্যন্ত ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশকারী ওই দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতেরা বঙ্গভবনে ১২ জানুয়ারি সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। কয়েকটি দেশের দূতেরা নির্বাচনের মান নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেও নির্বাচিত নতুন প্রশাসনের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে সেই হতাশা বাংলাদেশে বিদেশি সহায়তার ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। অবশ্য আজকের বাংলাদেশে বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যের বিষয়টি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি কেবল অর্থনীতি নয়, লাখ লাখ পরিবারের জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলে। আমাদের প্রধান দুটি বাজার হিসেবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের ক্ষমতা রাখে, যাতে তাদের বাজারে আমাদের রপ্তানি কমে যেতে পারে। তবে সে ধরনের আশঙ্কা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। আমরা একটি সার্বভৌম দেশ এবং যেকোনো ধরনের আন্তর্জাতিক চাপের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর স্বাধীনতা আমাদের রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো পদক্ষেপের চড়া মূল্য যদি সাধারণ জনগণকে দিতে হয়, তখন এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জোরালো জনসমর্থন প্রাপ্তির ব্যাপারে সরকারকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারত একটি ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে?
রেহমান সোবহান : অংশগ্রহণবিহীন হলেও একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রক্ষার পথে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ভারত তুলনামূলক বেশি সহানুভূতিশীল অবস্থান নিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে, এ রকম ভালো বন্ধুও একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্রের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে কদাচিৎ নির্বিকার থাকতে পারে, যাদের এবারের নির্বাচনী ম্যান্ডেট ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে অর্জিত ম্যান্ডেটের একটি ভগ্নাংশমাত্র। তা ছাড়া, ভারতের বর্তমান সরকার নিজেই একটি সন্ধিক্ষণে রয়েছে এবং এ সরকার হয়তো আগামী তিন থেকে চার মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকবে না। এ ধরনের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে যেকোনো সরকার তাদের বৈদেশিক নীতিতে বড় কোনো ধরনের পরিবর্তনে আগ্রহী হয় না। তাই আমাদের এমনটা আশা করা উচিত হবে না যে আগামী এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচনের পর নয়াদিল্লিতে নতুন একটি সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগে বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত খুব একটা সক্রিয় ভূমিকা নেবে।
প্রথম আলো : বিএনপি হরতালের মতো কর্মসূচি দিয়ে কোনো সুফল পাবে কি?
রেহমান সোবহান : খালেদা জিয়া গত ১৫ জানুয়ারি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে বৈঠকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা হরতালের মতো কর্মসূচি বন্ধ রেখে শান্তিপূর্ণ বিকল্প উপায়ে রাজনৈতিক সংহতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাবেন বলে জানিয়েছেন। নীতি এবং প্রাজ্ঞ রাজনীতির বিবেচনায় এটি একটি সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। হরতাল হচ্ছে প্রতিবাদ করার একটি উপায়। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটি গত কয়েক বছরে সব ধরনের রাজনৈতিক তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে। খুব সামান্য লোক আজকাল প্রতিবাদ জানানোর লক্ষ্যে হরতাল পালন করে। এখন যেভাবে হরতাল পালিত হয় তা কেবল সহিংসতার হুমকি দিয়ে লোকজনকে কাজে যেতে বাধা প্রদানের মধ্যেই সীমিত রয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিএনপির মিত্র জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহন লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে, যাতে সুনির্দিষ্টভাবে সাধারণ নাগরিকেরাই আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় হরতাল চলাকালে হতাহতের সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। ঢাকার মতো পুলিশবেষ্টিত অঞ্চলে হরতালের প্রভাব সামান্য হলেও দূরতর পাল্লার আন্তনগর যানবাহন চলাচলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া বিপণন, যোগাযোগ ও গণপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল নাগরিকদের দূরপাল্লার যাতায়াত বিপর্যস্ত হচ্ছে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিএনপির ভাবমূর্তি অনেকটাই নষ্ট হয়েছে, বিশেষ করে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মৈত্রীর কারণে। দলটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের পরিবর্তে যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে রাস্তায় সহিংসতা বাড়ানোর কৌশল বেছে নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সহিংসতা তাই অত্যন্ত অজনপ্রিয় হয়েছে, যাতে করে বিএনপির আন্দোলনের কর্মসূচির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
প্রথম আলো : সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে।
রেহমান সোবহান : সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অবলম্বনের কাজটি অত্যন্ত জঘন্য এবং কাপুরুষোচিত। কারণ, জনগণের সবচেয়ে অরক্ষিত অংশটি এই সহিংসতার লক্ষ্যে পরিণত হয়, যাদের প্রতিরোধের সামর্থ্য সবচেয়ে কম। আর যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে এ ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা হলে সেটা আরও নিন্দনীয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা নতুন নয় এবং রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনার পর থেকে বেড়েই চলেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সুনির্দিষ্ট হামলার সব রকম সম্ভাবনা ছিল। কারণ, তারা চিরাচরিতভাবে আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়ে থাকে—এমন ধারণা প্রচলিত রয়েছে। অতএব, সম্ভাব্য হামলা এড়াতে নির্দিষ্ট এলাকাগুলোতে আরও ভালো সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিল। অপরাধী যে-ই হোক না কেন, এ ধরনের হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু এটিই যথেষ্ট হবে না, যেহেতু আমাদের দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবনযাপন করছে। যেকোনো সরকারের আমলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
প্রথম আলো : অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, করণীয় কী?
রেহমান সোবহান : সহিংসতা ও হরতালের কারণে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে আরও ক্ষতি হতে পারে। যেসব দিনমজুর ও কৃষক তাঁদের ফসল বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। সব ব্যবসাই নির্ভরশীল পরিবহনব্যবস্থার ওপর। পণ্য সরবরাহ ও বাজারব্যবস্থায় বিঘ্ন হলে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং ব্যয় বৃদ্ধি পায়। তবে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্বল্পমেয়াদি প্রভাব, অন্তত সামষ্টিক অর্থনীতিতে, জিডিপি ও রপ্তানি বৃদ্ধির ভিত্তিতে পরিমাপ করা হয়। এটিকে অতিরঞ্জিত করা উচিত নয়। অব্যাহত রাজনৈতিক সংকটের প্রতিক্রিয়ায় আসলে অনিশ্চয়তার ওপরই জোর দিতে হয় এবং যা নতুন বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ওপর প্রভাব ফেলে এবং আমাদের রপ্তানি বাজারকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। অর্থমন্ত্রীর প্রতি সুপরামর্শ, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থায় অর্থনীতি রক্ষার স্বার্থে স্বল্পমেয়াদি কিছু উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে স্টেকহোল্ডারদের-স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করতে হবে এবং তাতে বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ধরনের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বিরোধী দল জনস্বার্থের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের প্রমাণদিতে পারে।
প্রথম আলো : কোনো অর্থবহ সংলাপের সম্ভাবনা কি এখনো আছে?
রেহমান সোবহান : সংলাপ আয়োজন করা সব সময়ই সম্ভব কিন্তু এটির কার্যকারিতা নির্ভর করবে পরিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে মীমাংসায় পৌঁছানোর ব্যাপারে উভয় দলের সদিচ্ছার ওপর। ক্ষমতাসীন জোট যদি মনে করে যে নির্বাচনে ম্যান্ডেট অর্জনের মধ্য দিয়ে তারা সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যেতে পারে যত দিন পর্যন্ত বিরোধী দল রাজপথে আন্দোলন পরিচালনার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে সরকার সংলাপের ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। এই নেতিবাচক উদ্দীপনার প্রভাব বিরোধী দলের ওপরও পড়তে পারে, যারা বিক্ষোভ-আন্দোলন অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে সম্ভাব্য আগাম নির্বাচনে (একাদশ সংসদ) জয়লাভের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার বাধ্যতামূলক উপায় মনে করতে পারে। এ ধরনের আন্দোলন থেকে চাপের মাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিএনপিকে রাজপথে জামায়াতের সহিংস কর্মকাণ্ডের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হতে হবে। সংলাপের মধ্য দিয়ে আরও গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার লক্ষ্যে উভয় জোট যদি এ ধরনের বিকৃত কৌশল পরিহার না করে, তাহলে রাজপথে সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কবলে পড়ে বাংলাদেশকে আবার একটি বছরব্যাপী অনিশ্চয়তায় পড়তে হতে পারে।
প্রথম আলো : নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি কি গণতন্ত্রে রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য?
রেহমান সোবহান : যেকোনো ধারণা, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাসহ, গ্রহণযোগ্য হবে যদি সেটি গণতন্ত্রকে উন্নীত করে এবং প্রধান দলগুলোর সমর্থন অর্জন করে। গণতন্ত্রে চিরন্তন কোনো ধারণা নেই। আসলে এটি মূলত এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যাতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে কোনো ধরনের ভয় বা জবরদস্তি বা সহিংসতার হুমকি ছাড়াই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিএনপি ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে প্রবর্তন করেছিল। এটি তৎকালীন বাংলাদেশে সব রাজনৈতিক দলের কাছে পরিপূর্ণভাবে অবশ্যই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ, ১৯৯৬ থেকে ২০১১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল হিসেবে বিবেচনা করেছে। কেবল ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর পরই ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অগণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যটি আলোচনায় আসে এবং এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়। নবম জাতীয় সংসদে প্রতিষ্ঠা করা হয় সংবিধান সংস্কারবিষয়ক সংসদীয় কমিটি। এটি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার সুপারিশ করে। এমনকি প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে তাঁর সংক্ষিপ্ত রায়ে পরামর্শ দিয়েছেন যে নতুন বিকল্প ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত সংসদ চাইলে আরও দুটি নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।