Published in ঢাকা টাইমস on Friday, 18 March 2016
মুক্তিযুদ্ধের অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান
মাহবুব রেজা
অর্থনীতির মানুষ হলেও রাজনীতিটা আর দশজনের চেয়ে ভালোই বুঝতেন। শুধু বুঝতেন একথা বললে বোধ করি ভুল বলা হবে। বরং বলাই শ্রেয় যে, তিনি রাজনীতির সুলুক সন্ধানের বিষয়-আশয় রাজনীতিবিদদেরও ভালো করে বুঝিয়ে দিতেন, ধরিয়ে দিতেন। রাজনীতিকরা অনেক সময় নানা কারণে গ-িবদ্ধতার মধ্যে আবদ্ধ থাকেন, নিজের কিংবা নিজেদের বোঝার বাইরে তারা যেতে চান না বা পারেন না। রাজনীতিকদের সেই ঘাটতির কথা কখনো কখনো মুক্তবুদ্ধির মানুষরা মোটা দাগে তুলে ধরতেন। কালে কালে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। দেশের আন্দোলন-সংগ্রাম, বিপর্যয় কিংবা অনিশ্চয়তার সময় মুক্তপ্রাণের মানুষ তাদের যুক্তি, বুদ্ধি, দর্শন, চিন্তা দিয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারা তাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়ে নিজেরাই হয়ে উঠেছেন বাতিঘর। অনুষ্ঠানের ভেতর বাতিঘর যেমন দিকভ্রান্ত মানুষকে আলোর দেখা দেয় তেমনি তারাও পথ নির্দেশ করেন জাতিকে।
রেহমান সোবহান। অর্থনীতির জটিল বিষয়কে সহজিয়া ভাষায় মানুষের মধ্যে প্রোথিত করার বাইরেও এক অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়ে নিজেই হয়ে উঠেছিলেন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। অর্থনীতিবিদ হিসেবে দেশে-বিদেশে নমস্য ব্যক্তিত্ব তিনি। মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালের ২২ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন রেহমান সোবহান। পড়াশোনা করেছেন দার্জিলিংয়ের ঐতিহ্যবাহী সেন্ট বালক স্কুলে। কলেজ জীবন লাহোরের অ্যাচিসন কলেজে। পড়াশোনায় সব সময় ক্লাসের প্রথম তিনজনের মধ্যে তার নাম ছিল অবধারিত। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, গানবাজনায়ও ছিল আগ্রহ। কলেজ শেষে ভর্তি হলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। ১৯৫৬ সালে ক্যামব্রিজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর অর্থনীতি নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পড়াশোনার সময়ই রেহমান সোবহানের সামনে পাকিস্তানের অস্থির সময়ে রাজনীতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছিল। দেশভাগের পর রাজনীতি যেন রাতারাতি চলে গেল পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর হাতে। পূর্ব ও পশ্চিমের রাজনীতি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াল যেখানে মানুষ মানুষের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সব প্রাপ্তিযোগ থেকে বঞ্চিত। শাসনের কড়া বেড়াজালে পশ্চিমের মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে যেন একঘরে করে রাখল। কোনো কিছুতে অধিকার খাটাতে পারবে না পূর্ব বাংলার মানুষ। শোষণ-বঞ্চনার এক মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা দিন দিন বাংলাদেশের মানুষের জন্য। মূর্ত হয়ে উঠতে লাগল বাংলার অধিকার বঞ্চিত মানুষ তাদের প্রাপ্য আদায়ে একাট্টা হয়ে উঠল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। শোষণ-বঞ্চনা-অবহেলা এ অঞ্চলের মানুষকে নানাভাবে বিশেষ করে রাজনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান করল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলল কী রাজনৈতিকভাবে কী সামাজিকভাবে কী সাংস্কৃতিকভাবে, কী অর্থনীতিতে, সব ক্ষেত্রেই মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অদ্ভুত জাদুকরী নেতৃত্ব ও ক্ষমতায় মানুষ একত্র হতে লাগল।
সময়টা রাজনৈতিক কারণে বেশ উত্তাল। ১৯৫৭ সাল। রেহমান সোবহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলেন। এর এক বছরের মধ্যেই দেশে সামরিক শাসন জারি করা হলো। দম বন্ধ করার মতো এক পরিবেশ। সামরিক শাসক ক্ষমতায় বসেই সংবিধান স্থগিত করলেন। রাজনীতির ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করে রাজনীতিকেও দুর্বিষহ করে তুললেন। রাজনৈতিক কর্মকা- যাতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যেতে না পারে সেজন্য রাজনীতিকদের ওপরও স্টিম রোলার চালাতে শুরু করলেন। তরুণ প্রভাষক তার ওপর মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে রেহমান সোবহান সামরিক শাসকদের এইসব জগা-খিচুরি টাইপের পরস্পরবিরোধী কর্মকা-কে সমর্থন করতে পারলেন না। তিনি রাজনৈতিকভাবে এসব জগা-খিচুরি মার্কা নীতির জবাব না দিয়ে কৌশল নিলেন ভিন্ন এক নীতির। রেহমান সোবহান তখনই বুঝে গিয়েছিলেন দেশের সাধারণ মানুষকে অর্থনীতির ভাষায় বোঝাতে হবে শোষণের চিত্র, বঞ্চনার চিত্র সর্বোপরি অবহেলার চিত্র।
পশ্চিমা শাসকদের এক পক্ষ নীতি চিত্রটি মানুষের সামনে বড় দাগে তুলে ধরতে হবে। অর্থনীতির বৈষম্যের সার্বিক চিত্রটি যখন মানুষ জেনে যাবে তখন সে এর নেপথ্যের রহস্যও উদঘাটনে সোচ্চার হবে। এই সোচ্চার হতে গিয়ে মানুষ রাজনীতির পার্থক্যটাও জানবে। তরুণ প্রভাষক তাই বেছে নিলেন লেখালেখি। যদিও আগে থেকেই লেখালেখির বিষয়টা তার মধ্যে ছিল। সামরিক শাসনের ফলে তিনি তার কলমকে তুলে ধরলেন সুউচ্চে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময় তিনি ‘ফোরাম’ নামের একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন। এই ফোরামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ড. কামাল হোসেন, হামিদা হোসেন, সালমা হোসেন প্রমুখ। ফোরামে তখন তার হাত ধরে নানা ধরনের লেখা ছাপা হতে লাগল। ছয় দফা আন্দোলন কিংবা তারও আগে থেকে ফোরাম তার বিষয় বৈচিত্র্যে ভরপুর লেখায় মানুষকে সচেতন করে তোলার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
সত্তরের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধ সব কিছুতে ফোরাম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে তার ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে। শুধু ফোরাম সম্পাদনা নয়, তিনি এর প্রবন্ধকার, প্রতিবেদক, পরিকল্পনাকারী, এক হাতে নিজে ফোরামের সব কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতেন। ফোরাম বের করতে গিয়ে রেহমান সোবহান প্রধান্য দিয়েছেন এক দেশে দুই অর্থনীতি, বাঙালি ও পশ্চিম পাকিস্তানের আলাদা জাতিসত্তা, দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যসহ অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-আশয়। তার লেখার ধার ও যুক্তি, বুদ্ধি ও চিন্তার স্পষ্টতা সে সময়ে রাজনীতিবিদদের প্রেরণা ও সাহস যোগাত। একই সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সখ্য ও ঘনিষ্ঠতা তাকে এমন লেখায় নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করল। ফোরামে রেহমান সোবহান একাধিক নামে সময়োপযোগী লেখাগুলো লিখতেন। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকালে বাঘা-বাঘা রাজনীতিকরা যখন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছিলেন তখন রেহমান সোবহান ছিলেন সদা সোচ্চার। ১৯৬১ থেকে ’৭১ সাল পর্যন্ত ফোরামে প্রকাশিত তার লেখা প্রকৃত অর্থে ষাটের দশকের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের এক জীবন্ত দলিল। এই লেখায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য নিয়ে বুদ্ধিভিত্তিক তর্কেই জড়িয়ে যাননি তিনি তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এই চেতনার বীজটি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের গোড়ার দিককার কথা। ১৯৬১ সাল। লাহোরে অনুষ্ঠিত একটি একাডেমিক আলোচনা সভায় রেহমান সোবহান ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’ তত্ত্ব হাজির করলেন। রেহমান সোবহান সামরিক শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’ উপস্থাপন করার পর চারদিকে বেশ হইচই পড়ে যায়। তরুণ অধ্যাপক রেহমান সোবহান নানা রকম তথ্য-উপাত্ত বের করে আলোচনায় প্রমাণ করে দিলেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কী ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। রপ্তানির সিংহভাগ আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে এলেও বাজেটের বেশিরভাগ বরাদ্দ পায় পশ্চিম পাকিস্তান। তিনি তার আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালির উদাহরণ টেনে এনে বলেছিলেন, দেশের যে অংশ পিছিয়ে আছে, সেই অংশের উন্নয়নে রাষ্ট্রের অধিক বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তার এ কথাকে আমলে নেয়নি।
মূলত আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকালে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার, আঞ্চলিক বৈষম্যের কথা সবাই জানলেও সংবাদপত্রগুলো তা প্রকাশ করার সাহস রাখল না। সে সময় রেহমান সোবহান বিভিন্ন সভায় শাসক গোষ্ঠীর দ্বৈত অর্থনীতির বিষয়ে স্পষ্ট কথা বলতেন। তার লক্ষ ছিল, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনীতির মানুষজনকেও এই দ্বৈত অর্থনীতির বিষয়ে সচেতন করে তোলা, প্রতিবাদী করে তোলা। অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হওয়ার ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আলাদা অর্থনীতির দাবিও ওঠে। পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান পৃথক অর্থনীতির দাবিকে কঠোর ভাষায় নাকচ করে দিয়ে এক অভিন্ন অর্থনীতির কথা উচ্চারণ করেছিলেন। সে সময় পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল, ‘আইয়ুব বলছেন এক অর্থনীতি।’ একই সময়ে আরেকটি পত্রিকায় সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘রেহমান বলছেন দুই অর্থনীতি।’ পত্রিকায় এই পরস্পরবিরোধী সংবাদ প্রকাশিত হলে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে আইয়ুব খানের সরাসরি প্রশ্ন ছিল, ‘এই রেহমান সোবহানটা আবার কে?’
রেহমান সোবহান তার মুক্তবুদ্ধি, দেশপ্রেম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধী দলের সম্মেলনে ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপন করলে মানুষের মধ্যে তার ব্যাপক প্রতিফলন দেখা দেয়। গণজাগরণ সৃষ্টি হয় ছয় দফাকে কেন্দ্র করে। ছয় দফার পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলনের হাত ধরে দেশ ধীরে ধীরে এগুতে থাকে স্বাধীনতার মন্ত্রে। এই সময় রেহমান সোবহান তার দূরদর্শিতার প্রমাণ রেখে লিখেছেন, ছয় দফা তখন আর একটি রাজনৈতিক দলের সম্পত্তি থাকে না, তা হয়ে ওঠে দেশের মানুষের মুক্তির সনদ। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, দুই অর্থনীতি, তত্ত্ব, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা এবং ১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাব সবই উত্থাপিত হয়েছিল লাহোরে। একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, রেহমান সোবহানের দুই অর্থনীতি তত্ত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। লাহোরে যখন তিনি তার ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’ তত্ত্বটি উপস্থাপন করলেন তখন থেকেই পাকিস্তানিদের মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। একটি বৈরী পরিবেশে রাজনীতিকরা যেখানে শাসক গোষ্ঠীকে বিচলিত করার সাহস পায় না, সেখানে একজন তরুণ অর্থনীতিবিদ তার বক্তব্য দিয়ে শাসক গোষ্ঠীকে ভাবিয়ে তুলেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে নানাভাবে বিশ্লেষণ ও অধিকতর পর্যালোচনা করার অবকাশ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকে খুব কাছে প্রত্যক্ষ করেছেন রেহমান সোবহান। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দ্বৈত অর্থনীতির বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে তাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে সখ্য থাকায় তাকে নানাভাবে হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি ৩১ মার্চ দিল্লি পৌঁছেন। এরপর তাজউদ্দিন আহমদের কথামতো এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডনে ও এপ্রিলের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের পাশাপাশি প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠনটি করেন তিনি। লন্ডন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে মুজিবনগরে ফিরে মন্ত্রিসভার কাছে রিপোর্টও পেশ করেছেন তিনি। স্বাধীনতার পর রেহমান সোবহান বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অর্থনৈতিক দূতের কাজও করেছিলেন। স্বাধীনতার পরে প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে কাজ করেছেন।
১৯৭৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ মর্যাদায়); শিল্প, বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ এবং অবকাঠামো বিভাগে (১৯৭২-৭৪) যথাক্রমে চেয়ারম্যান, গবেষক, পরিচালক, মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭২-৭৪ সাল পর্যন্ত বিআইডিএসএ ইমেরিটাস ফেলো হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া কুইন এলিজাবেথ হাউসে ১৯৭৬-৭৯ সাল পর্যন্ত ভিজিটিং ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রেসিডেন্টের অ্যাডভাইজারি কাউন্সিল (ক্যাবিনেট মিনিস্টারের পদ মর্যাদায়) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (১৯৯১) সদস্য ছিলেন। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। ১৯৯৪-১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন।
রেহমান সোবহান সব সময়ই স্বপ্নবান মানুষের প্রতীক। তিনি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। তিনি তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ করে চলেছেন নিরন্তর। তার কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আইয়ুব খানের কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির সম্পর্ক, মধ্যবর্তী শাসন পদ্ধতিতে সর্বজনীন সাহসী উদ্যোগের ভূমিকা, বৈদেশিক নির্ভরশীলতার সংকট, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা, কৃষিজ সংস্কার, সমন্বয়নীতি সংস্করণের সমালোচনামূলক নিবন্ধ, দুঃশাসনের ব্যবচ্ছেদ, দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল। এছাড়া রেহমান সোবহান ‘মুক্তিযুদ্ধের অর্থনীতিবিদ’ হিসেবেও দেশে-বিদেশে খ্যাত।
অতি সম্প্রতি রেহমান সোবহানের নতুন বই ‘ফ্রম টু ইকোনমিস টু টু নেশনস মাই জার্নি টু বাংলাদেশ’ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সাল এই দশ বছরে তার লেখা কলাম, নিবন্ধ, সম্পাদকীয় নিয়ে এই বই। বইটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন থেকে মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তি, এই সময়কালে রচিত তার লেখায় নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। রেহমান সোবহান তার নতুন বইতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নতুন চিন্তার খোরাক দেবে, ভিন্ন চিন্তার অবতারণা করবে। আশি বছর অতিক্রম করা রেহমান সোবহান মুক্তচিন্তা এবং অগ্রসর ভাবনায় এখনো যে কোনো তরুণের চেয়ে অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। ক্রিয়াশীল।