কামরুলের বাড়ি ফেরা

ড. আনিস পারভেজ

অতিরিক্ত পরিচালক, সংলাপ ও যোগাযোগ, সিপিডি

কামরুল বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। এক যুগ আগে ভোলার একটি গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিল জীবন গড়বে বলে। না, ভুল বললাম—জীবন গড়ার পুঁজি কামরুলদের নেই, ওরা নিম্নবর্গের। কামরুল ঢাকায় এসেছিল শুধুই অন্ন যোগাতে। ধানমণ্ডির একটি এপার্টমেন্ট ভবনে সে দারোয়ান, প্রতিদিন দশ ঘণ্টা ডিউটি, ছুটি নেই, বেতন সাড়ে চার হাজার টাকা। অহোরাত্র পরিশ্রম করে। আমরা এপার্টমেন্টের বাসিন্দারা ঘরে ফিরলে এগিয়ে এসে আমাদের মালসামাল লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়—কখনও কখনও বখসিশ মেলে।

কামরুলের কিডনি সক্রিয়তা হারাচ্ছে, ও আর কর্মক্ষম নয়, চিকিৎসা করাবার সামর্থ্য নেই। পকেট খালি হবে কোত্থেকে, ওদেরতো পকেটই নেই, এবং রাষ্ট্রও তাদের জন্য চিন্তার ভার নেয় না—নির্ভার রাষ্ট্র। উচ্চবর্গের নাগরিকরা ব্যস্ত ভোগের ম্যারাথনে, আর পণ্ডিতরা তত্ত্ব চিন্তায় নিমগ্ন। সবার কাছেই কামরুল একটি অনুপস্থিত অস্তিত্ব।

কিন্তু দেশে উন্নয়ন হচ্ছে; সবাই এরকমই বলছে। এ “সবাই”টা কিন্তু সংখ্যার ভারে নয়, গুণের ধাক্কায়। স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম অথবা সম্পদ লুটপাটের সার্কাসটি ভাল জানে বলে সংখ্যায় অল্প হলেও রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতার তারা নিয়ন্ত্রক। উন্নয়নের সবটুকু ক্রিম তাদের করায়ত্ত। রাষ্ট্র ও উচ্চবর্গের নাগরিকের ভাবনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অনুপস্থিত। তাই এ কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয় যে দেশে আয়, ভোগ ও সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে জ্যামিতিক হারে।

রাষ্ট্রকে গাল দেয়ায় আরাম আছে, এতে নিজের দায় একটি প্রতিষ্ঠানের উপর চাপিয়ে দেয়া যায়। সম্ভবত উচ্চবর্গের নাগরিক চায়ও রাষ্ট্রের অচলাবস্থা, এতে নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থা নিশ্চিত হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান তো কোন গায়েবি জিনিষ নয়, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার পদ্ধতিগত কাঠামোই প্রতিষ্ঠান, যা আমরা তৈরি করি আমাদের দেখভালের জন্য। পদ্ধতিগত কাঠামো হিসেবে রাষ্ট্রের থাকে আইন প্রণয়ক ও নিয়ন্ত্রক, প্রশাসক, বিচারক, শিক্ষক, চিকিৎসক এবং বিবিধ সার্ভিস দেয়া বিভিন্ন পেশাগোষ্ঠী। মৌল আদর্শের নিরিখে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়—এরকমই হবার কথা।  মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই আমাদের আদর্শ নিরূপিত হয়েছিল—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের স্পিরিট ও অনুশাসনে পরিচালিত হবে বাংলাদেশ।

কোথায় সে আদর্শ? কাগজে আছে, প্রচ্ছন্ন ভাবে পলিসিতেও আছে, আর জ্বলজ্বল করে আছে রাজনৈতিক মিথ্যাচারে। কিন্তু নাগরিক পরিসেবায় এর প্রতিফলন কোথায়? নাগরিকের প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা। প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রকেই এর গ্যারান্টি দিতে হবে। এ চারের ঘাটতি থাকলে ক্রমাগত ৭% অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটলেও তা কেবলই শুভঙ্করের ফাঁকি। এরকম উন্নয়ন আসলে প্রতারণা, কেননা ফুলে ফেঁপে ওঠা অর্থ ধুরন্ধর উচ্চবর্গের পকেটস্থ হয়।  সে অর্থের ব্যবহার হয় তাদের ভোগ বিলাসে, যার একটি দৃশ্যমান অবকাঠামো আছে, তা দেখে প্রতারিত মন ভুল করে তাকে ভাবে উন্নয়ন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটেনে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকেই চার্চিল সেদেশে সব নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রের পয়সায় স্বাস্থ্যবীমা প্রচলন করেন। গোটা উত্তর ইউরোপে নাগরিকবান্ধব স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আছে, যা গড়ে উঠেছে সে দেশগুলোতে অর্থনৈতিক প্রাচুর্য আসার আগেই। একটি রাষ্ট্রীয় আদর্শের আন্তরিক বাস্তবায়ন ছাড়া নাগরিকের সেবা সম্ভব নয়। সেবা ছাড়া অসম্ভব নাগরিকের গুণ ও মেধার পরিস্ফুটন, এবং চূড়ান্ত অর্থে এর অনুপস্থিতিতে উন্নয়ন শুধুই ছেলে ভোলানো মোয়া।

সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ছিটে ফোটাও নেই বলে কামরুলকে বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে। হয়তো তার ছিন্ন কুটিরের পেছনে একটি বাঁশঝাড় আছে, চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর পর সেখানেই সে সমাহিত হবে।

কামরুলের স্ত্রী, পুত্র কন্যা সে বাঁশঝাড়ে দাঁড়িয়ে কি কাঁদবে না রাষ্ট্র ও তার উচ্চবর্গকে অভিশাপ দেবে?