Published in সমকাল on Wednesday, 13 July 2016
নিরাপত্তা ঝুঁকি দূর করতেই হবে
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
ধর্মান্ধ চরমপন্থি একটি মহলের সশস্ত্র তৎপরতা বাংলাদেশে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ ধরনের একটি গোষ্ঠী আলবদর-রাজাকার বাহিনী সংগঠিত করেছিল। তবে তারা কাজ করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে। ২০০৫ সালে আমরা বাংলাদেশে জেএমবি নামে পরিচিতি পাওয়া একটি গোষ্ঠীর দৃশ্যপটে আবির্ভাব দেখেছি, যারা একদিনে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা চালাতে পেরেছিল। তারা দেশের আরও কয়েকটি স্থানে আত্মঘাতী বোমা-গ্রেনেড হামলা পরিচালনা করে, যাতে অনেক হতাহত হয়। এর আগেও রমনা বটমূলে বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানসহ কয়েকটি জনাকীর্ণ স্থানে এ ধরনের হামলা আমরা দেখেছি। সরকার এ ধরনের অপতৎপরতা দমনে কঠোর অবস্থান নেয় এবং কয়েকজনের শাস্তি হয়। এ ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা বাংলাদেশের মানুষ আদৌ পছন্দ করে না।
১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিসান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার প্রকৃতি আগের বিভিন্ন হামলার তুলনায় নিঃসন্দেহে ভিন্নতর। এ হামলার টার্গেট ছিল বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিরা। সন্ত্রাসীরা ২০ জনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। তাদের মধ্যে নারীও রয়েছেন। হামলাকারীদের রুখতে গিয়ে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা অন্তত অর্ধশত। এ ঘটনার পর দেশব্যাপী নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। কিন্তু ৭ জুলাই পবিত্র ঈদের দিনে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতের কাছেই সন্ত্রাসী হামলা হয়। এতে একজন হামলাকারী নিহত হয়। তাদের প্রতিহত করতে গিয়ে পুলিশ বাহিনীর দু’জনের মৃত্যু হয়েছে।
এ দুটি ঘটনা দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। তবে ১ জুলাই গুলশানের ঘটনাটির সঙ্গে বাড়তি উপাদান রয়েছে_ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা। এর কয়েকটি দিক রয়েছে। প্রথমত, ইমেজ সংকট। সাধারণভাবে ধারণা রয়েছে_ বাংলাদেশ মধ্যপন্থি মুসলিম দেশ এবং এখানে ধর্মীয় চরমপন্থি শক্তির তেমন অবস্থান নেই। গুলশানে যেসব বিদেশিকে হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ১৬ জন জাপানি ও ইতালীয় নাগরিক। তাদের বেশিরভাগ বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। এ দুটি দেশের একজন করে নাগরিক বছরখানেক আগে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন। এর পেছনে কারা জড়িত, সেটা নিয়ে এখন পর্যন্ত সংশয় রয়ে গেছে। সঙ্গত কারণেই ওই দুটি দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ১ জুলাইয়ের হামলা ঘটেছে। এখন জরুরি কাজ হচ্ছে ইমেজ সংকট দূর করায় উদ্যোগ গ্রহণ। প্রধানমন্ত্রীসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ নিহতদের জন্য শোক প্রকাশ করেছেন। আর্মি স্টেডিয়ামে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাদের স্মরণ করা হয়েছে। আমাদের বিশেষভাবে এখন সচেষ্ট হতে হবে, যাতে এসব ঘটনার বিরূপ প্রভাব অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর না পড়ে। আমরা জাপান টাইমসের খবর থেকে জেনেছি, যেসব জাপানি ১ জুলাই হলি আর্টিসানে নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা আন্তরিকভাবে চাইছেন যাতে তাদের স্মৃতিবিজড়িত বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোতে জাপান সরকারের সহায়তা অব্যাহত থাকে। এ ধরনের ঔদার্য আমাদের মুগ্ধ করে। আমরা পরিসংখ্যানের প্রতি তাকাতে পারি। জাপানে বাংলাদেশ প্রতি বছর ১০০ কোটি ডলারের মতো পণ্য রফতানি করে। বাংলাদেশে তাদের মোট বিনিয়োগ রয়েছে ৩৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের মতো। গত বছর বাংলাদেশ জাপানের কাছ থেকে ঋণ সহায়তা পেয়েছে ২২ কোটি ৭০ লাখ ডলারের, যার জন্য সুদ দিতে হবে নামমাত্র হারে।
ইতালিও বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত এ দেশটিতে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা পাচ্ছে। বছরে সেখানেও ১০০ কোটি ডলারের মতো পণ্য রফতানি হয়। বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ রয়েছে ৪ কোটি ডলারের বেশি।
উভয় দেশই অর্থনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হলি আর্টিসানের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় তা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য আমাদের সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে। এর পেছনে মানবিকতার তাগিদই প্রধান হতে হবে। তারা আমাদের দেশে কাজ করছিলেন আমাদেরই কল্যাণের জন্য। কিন্তু নিষ্ঠুর ঘাতকরা তাদের প্রাণ কেড়ে নিল। তাদের প্রতিটি পরিবারের জন্য আমাদের শোক ও সমবেদনা। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল নিহতদের প্রতিটি পরিবারের কাছে সরাসরি উপস্থিত হয়ে শোক প্রকাশ করলে সেটাই হবে যথার্থ পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতও যেতে পারেন।
বড় ধরনের সন্ত্রাসী অভিঘাত নানাভাবে আসে। এখন কোনো কোনো দেশ কিংবা একসঙ্গে অনেক দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে কিংবা নতুন করে বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতে পারে। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিও বাংলাদেশের পরিস্থিতি গভীর মনোযোগসহ পর্যবেক্ষণ করবে। যেহেতু বাংলাদেশে নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে তাই ঋণের পরিমাণ, সুদের হার ও বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে এর প্রভাব পড়তে পারে। এখন আমাদের জরুরি কাজ হবে নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্বেগ যত দ্রুত সম্ভব কাটিয়ে ওঠা যায়, সেজন্য সচেষ্ট হওয়া। এ জন্য সরকারি পর্যায়ে তৎপরতা চাই। একই সঙ্গে বেসরকারি পর্যায়েও উদ্যোগ থাকতে হবে। গণমাধ্যমের সহযোগিতাও গুরুত্বপূর্ণ। দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও কিন্তু থমকে থাকতে পারে। এমনিতেই বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেই। মূলধন পাচার উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়_ দেশে বিনিয়োগে যথেষ্ট আস্থা নেই।
বাংলাদেশ এখন ঋণ-অনুদানের ওপর আগের মতো নির্ভরশীল নয়। অর্থনীতির ভিত একটু একটু করে শক্ত হচ্ছে। কিন্তু তার পরও উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এ ধরনের সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে, সেটা স্বীকৃত। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর আমাদের বৈদেশিক সাহায্য কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে বলে ধারণা করা হয়। যেমন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার। উন্নয়ন সহযোগীদের নিরাপত্তা বাহিনীর দক্ষতা ও অস্ত্রসজ্জার প্রতি মনোযোগ বাড়তে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিদেশিদের বাংলাদেশে আগমন ও অবস্থানের সময় কমে গেলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। এর প্রভাব পড়তে পারে পর্যটন শিল্পে। তবে সরকার যদি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করার মতো দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে, তাহলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই শঙ্কা কাটতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে। এর প্রকৃতি কী ধরনের হবে, সেটা এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট। তবে সরকার কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে সেটা দেখতে চাইবে সবাই। এটা ঠিক, চোরাগোপ্তা সন্ত্রাস সব ক্ষেত্রে মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না। কিন্তু ব্যক্তি কিংবা সম্পদের ওপর আঘাত হেনে কেউ রেহাই পাবে না, সেটা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার বিষয়টিও সর্বদা মনে রাখা চাই।
সন্ত্রাসবাদের সংকট বৈশ্বিক। একই সঙ্গে স্থানীয় মদদও থাকে। সন্ত্রাসবাদ দমনে আন্তর্জাতিক সহায়তার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের কোথায় ঘাটতি আছে, সেটা চিহ্নিত করতে হবে। গোয়েন্দা বাহিনী আগেভাগে সতর্কতা জানাতে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ_ এমন সমালোচনা রয়েছে। তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক সমর্থন প্রদান করার বিষয়টি এখন নতুন গুরুত্ব পাবে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পর্যায়ে ব্লেমগেম বা পারস্পরিক দোষারোপের ঘটনা আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু সবাইকে বুঝতে হবে যে দেশের স্বার্থ সবার ওপরে। বিশেষভাবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রভাবিত হওয়া। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিক কাজ করছেন। বাংলাদেশকে বিদেশিরা নিরাপদ মনে না করলে প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশিদের জন্যও তা সমস্যার কারণ হতে পারে। তারা বাড়তি নজরদারিতে পড়তে পারেন। নতুন কর্মী নেওয়া বিঘি্নত হতে পারে। সর্বোপরি, সমস্যা দেখা দিতে পারে রেমিট্যান্স প্রবাহে। আমাদের দলমত নির্বিশেষে এ বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হবে। আমার বিবেচনায়, বর্তমান অবস্থায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদবিরোধী একটি অরাজনৈতিক প্লাটফরম গড়ে তোলা জরুরি। জেলা, উপজেলা, গ্রাম_ সর্বত্র তারা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কাজ করবে। জঙ্গিবাদ মোকাবেলার কৌশল নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথাও ভাবা যেতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের বেসরকারি সংস্থা-সংগঠনকে যুক্ত করা যায়। জাতিসংঘও এ উদ্যোগে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে।
বাংলাদেশে বিদেশি কর্মীরা যেসব প্রকল্পে কাজ করছেন সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে ভাবতে হবে পদ্মা সেতুর কথা। নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি নজর দেওয়ার পাশাপাশি সাময়িক একটি পদক্ষেপও বিবেচনা করা যায়_ যেখানে যেখানে সম্ভব স্থানীয় কর্মীদের দিয়ে কাজ চালানো। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যে সুবিধা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে তার সহায়তাও নিতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্তরাও এ বিষয়টি ভাবতে পারেন। প্রয়োজনবোধে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বেসামরিক নিরাপত্তা সার্ভিসের সুযোগ গ্রহণের বিষয়টিও বিবেচনা করতে পারে। নিরাপত্তা নিয়ে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা দূর করতেই হবে।
অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)