Published in সময়ের আলো on Sunday 26 May 2019
সময়ের আলো সাক্ষাৎকার
এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতির নিরিখে এবারের বাজেট দেখা উচিত
প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান সম্মানীয় ফেলো, সিপিডি
প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের যে বাজেট আসছে এবং এবারের বাজেটের যে ধরনের আকার হবে বলে মনে হচ্ছে তাতে বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন যে চাহিদা সেটার তুলনায় খুব বড় বলে মনে হয় না। এটা মাথাপিছু হয়তো ৩০ হাজার টাকার মতো হবে। যেটা উন্নয়নশীল দেশের মানুষের মাথাপিছু যে বাজেট গড় তার চেয়ে এখনও আমাদের দেশে অনেক কম। তা ছাড়া জিডিপির হার হিসেবেও যদি ধরি সেটি ১৮ শতাংশের মতো হবে। সেটাও খুব বেশি যে বড়, তা না। বরং আমাদের চিন্তা করা উচিত, বাজেটের সম্পদ আহরণ, বন্টন, আয়ের পুনঃবন্টন এবং বাস্তবায়ন- এই চারটি দিকে আমাদের বেশি নজর দেওয়া দরকার। কারণ এখন যে প্রেক্ষাপটে বাজেটটি হচ্ছে, এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, এসডিজির যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব বিষয় মাথায় রেখে আগামী বাজেটকে দেখা উচিত। আরেকটি বিষয় হলো- সপ্তম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনারও শেষ বাজেট এটি, সুতরাং সেদিক থেকেও সপ্তম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বাজেট হতে হবে।
এসব বিষয়কে যদি আমরা প্রেক্ষাপট হিসেবে রাখি, তাহলে যে চারটি বিষয় উল্লেখ করলাম তার মধ্যে প্রথম বিষয়টি ছিল সম্পদ আহরণ। আমরা দেখছি এবং আমরা জানি সম্পদ আহরণের দিক থেকে আমাদের অনেক বড় ধরনের দুর্বলতা আছে এবং সেটি আরও পরিস্ফ‚টিত হচ্ছে। চলমান অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আহরণের যে প্রাক্কলন করা আছে সেটির চেয়ে তো কম হবেই, বরং পরে লক্ষ্যমাত্রা রিভাইজ করেছে, সেটিও পূরণ হবে না। এবারের বাজেটে কীভাবে ভিত্তি বাড়ানো যায়, কীভাবে ভ্যাট বাড়াতে পারি, কীভাবে প্রত্যক্ষ করা বাড়ানো যায়, কীভাবে রাজস্ব আদায় আরও বাড়ানো যায় সেদিকে বেশি নজর দিতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- প্রত্যক্ষ করের অংশ, যেটা এখনও ওয়ান থার্ড আছে। তা ছাড়া ব্যক্তি খাতের কর ওয়ান থার্ডেরও ওয়ান থার্ড। এই জায়গায় কীভাবে আরও বাড়ানো যায়, সেদিকে এবার বেশি নজর দিতে হবে।
ভ্যাটের বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, একবার সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ৬ লাখ জায়গা থেকে ভ্যাট সংগ্রহ করা হয়। ব্যাংকিং খাত, এনবিআরসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থার কাজে যদি সমন্বয় ঘটানো যায় তাহলে হয়তো ঘাটতি কমানো সম্ভব হবে। সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যে বিষয়টি উল্লেখ করব সেটি হলো, যদিও ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, তা ছাড়া অনলাইন ভ্যাট করার কথা ছিল- কিন্তু এ বিষয়গুলোও পিছিয়ে আছে। সুতরাং বাজেটে এ জায়গাতেও দিক নির্দেশনা দেওয়া দরকার। তৃতীয় বিষয় হলো- নন ট্যাক্স রেভিনিউ কিন্তু আমাদের ২০ শতাংশের মতো। এখানেও দেখার বিষয় আছে। এখানে বিভিন্ন রকম ফি আছে, ডিউটি আছে- সেগুলোকে আরও রিভাইজড করা দরকার, যুগোপযোগী করা, আদায় করা, ডিজিটাইজড করা। এসব করলেও কিন্তু আমাদের কর আদায়ের ক্ষেত্রটা বাড়ে।
তিনি বলেন, সম্পদ বন্টনের বিষয়ে বললে বলতে হয়, সম্পদ বন্টনের বিষয়ে তারতম্য আছে। আমাদের শিক্ষা খাতের বাজেট বরাদ্দ ২ শতাংশ আছে সেটি ৩ শতাংশে নেওয়া, ইউনেস্কো বলেছে- স্বাস্থ্য খাতের বাজেট ২ শতাংশে নেওয়া দরকার। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ মাত্র দশমিক ৭৭ শতাংশ। এসব ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে যেতে হবে, একবারে যাওয়া যাবে না। কিন্তু বিষয় হচ্ছে- এসব খাতে যে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হবে, তাহলে কমানো হবে কোথায়। সরকারি ব্যয়ের যে সংস্কার সেখানে তদন্ত করে প্রমোশন করা বা পুনর্বিবেচনার একটা সময় এখন চলে এসেছে। কোথায় থেকে কমিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানো যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশকে আস্তে আস্তে সোশ্যাল সেফিট নেট থেকে সোশ্যাল সিকিউরিটির দিকে নিয়ে যেতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো- আমরা বড় বড় অবকাঠামো যেগুলো করছি সেগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে বিলম্ব করার কারণে অনেক ব্যয় বাড়ছে। এখানে সাশ্রয়ীভাবে করা, সময়মতো করা দরকার। বড় বড় টাকা সেখানে ব্যয় হচ্ছে। এখানে বেশি নজর দিতে হবে এবং কাজে আরও স্বচ্ছতা আনতে হবে। এসব বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং দক্ষ লোক দরকার সেখানে ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং সক্ষমতা বাড়ানো, দক্ষ লোকবল বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ বড় প্রকল্পগুলো নির্মাণ হওয়ার পর সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও তো দক্ষ জনবল লাগবে। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখারও দরকার আছে।
বাজেট বাস্তবায়নের বিষয়ে বললে বলতে হয়, আমাদের দেশে বাজেটের আকার যে হারে বেড়েছে, সে হারে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি এবং দক্ষ জনবল থাকার দরকার ছিল, সে হিসেবে আমরা সেগুলো বাড়াতে পারিনি। যার ফলে ভালো প্রকল্প পরিচালক পাওয়া যায় না, বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা হয়। লোকাল গভর্নমেন্টের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ থাকে সেগুলোর সঠিক বণ্টন ও বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সোসাইটিকে নিয়ে যদি মনিটরিংয়ের জন্য একটি কাঠামো দাঁড় করানো যায় তাহলে হয়তো সাশ্রয়ীভাবে করা যেতে পারে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একবার এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পরে সে উদ্যোগ আর আলোর মুখ দেখেছে বলে মনে হয় না। সুতরাং একদিকে বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়ানো দরকার, অন্যদিকে বাস্তবায়নের গুণগত মান নিশ্চিত করা দরকার। তা ছাড়া সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোকে আরও অ্যাক্টিভ করারও প্রয়োজন আছে।
এরপর বাজেটের বড় যে বিষয়টি নিয়ে বলব সেটি হলো- পুনঃবন্টনের দিকটি। সব দেশের বাজেটেরই একটি বড় দিক হলো- যারা অপেক্ষাকৃত বেশি আয়ের তারা বেশি কর দেয়। পরে কম আয়ের লোক যারা তাদের মধ্যে সমন্বয় করা হয়। এতে সমাজে একটা সমতা আসে এবং সম্পদের পুনঃবন্টন হয়। বাংলাদেশে এখন যেমন ভোগ বৈষম্য থেকে আয় বৈষম্য বেশি, এ রকম একটি দুষ্ট চক্র আমরা দেখছি। যদিও বাংলাদেশ বিভিন্ন সূচকে গড়ে বেশ ভালো করছে তবুও সম্পদ বন্টনে অনেক বিশৃঙ্খলা রয়েছে, এ বিষয়ে আমাদের চিন্তা করা উচিত। সেটা করতে গেলে কিন্তু আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা এবং প্রত্যক্ষ করের অংশ বাড়ানো দরকার। এগুলোতে আমাদের নজর আরও বেশি দিতে হবে। তা ছাড়া সাধারণ মানুষের সঙ্গে যে খাতগুলো সংশ্লিষ্ট, যেমন আমি যদি স্বাস্থ্য খাত নিয়ে বলি, তাহলে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে যা ব্যয় হয় তার ৭৫ শতাংশ নিজ থেকে ব্যয় করতে হয়। ভুটানে সেটি ২০ শতাংশ আর শ্রীলঙ্কায় সেটি ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতের যেসব বিনিয়োগ আছে সিংহভাগই সরকার বহন করে। ঠিক একই রকম শিক্ষা খাতের দিকেও বেশি নজর দিতে হবে। মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকতে হবে।