Published in প্রথম আলো on Sunday, 6-7 March 2016
স্বাধীনতার মাস
তখন কার্যত বঙ্গবন্ধুর শাসন চলছিল
রেহমান সোবহান
১৯৭১ সালের ৫ মার্চ পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এর ফলে অসহযোগ আন্দোলন এক ঐতিহাসিক মাত্রা পেয়ে যায়, যা আগে কেউ কখনো দেখেনি। বেসামরিক আমলাতন্ত্র, পুলিশ, প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের সব অংশ গদিনসীন সরকারকে সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বদরুদ্দিন সিদ্দিকি জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানালে অসহযোগ আন্দোলন চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছায়।
সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের সব স্তরের প্রতিনিধিরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকলে অসহযোগ আন্দোলন গুণগত দিক থেকে এক ভিন্ন মাত্রায় উন্নীত হয়। আমলাদের পরপরই বঙ্গবন্ধুর প্রতি সমর্থন জানান ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা, সে সময় তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন অবাঙালি, তাঁরাও বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন জানান। পৃথিবী আন্দোলন দেখেছে অনেক; কিন্তু আমার জানামতে সেসব আন্দোলনের কোনোটাই এ রকম পর্যায়ে পেঁৗছায়নি, যখন সরকারি প্রশাসন, পুলিশ বাহিনী ও আদালতগুলো শুধু ক্ষমতাসীন সরকারের আদেশ-নির্দেশই অমান্য করেনি, বরং এমন একজন রাজনৈতিক নেতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল, যিনি কোনো সরকারি পদে ছিলেন না।
তারপর, ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে সেই বহুল প্রত্যাশিত জনসভা, যেখানে বঙ্গবন্ধু তাঁর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা উচ্চারণ করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, সেখানে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন বলে অনেকেই অনুমান করেছিল। আবার একই সঙ্গে এ ধারণাও ছিল যে তিনি সেটা করলে কুর্মিটোলায় ঘাঁটি গেড়ে থাকা পাকিস্তানি বিমানবাহিনীকে ওই জনসভায় বোমাবর্ষণ করার নির্দেশ দিয়ে রাখা হয়েছে, যেটা হবে সেনাবাহিনীর হাতে সুচিতব্য এক পূর্ণাঙ্গ গণহত্যার অবতরণিকা। এই অনুমান যে সত্য ছিল, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে পরবর্তী সময়ে জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার স্মৃতিকথা থেকে, যিনি লিখেছেন, তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে এই সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিলেন যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হলে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীগুলোর দিক থেকে সর্বাত্মক সামরিক আক্রমণ ডেকে আনা হবে।একটাই দাবি: স্বাধীনতা
কামাল হোসেনের কাছ থেকে আমি জানতে পারি, ৭ মার্চের জনসভার আগের দিন ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের এক বৈঠক বসে। সারা দিন পেরিয়ে রাত পর্যন্ত গড়ায় সে বৈঠক। পরদিনের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য কী লাইনে হওয়া উচিত, সেটাই ছিল ওই বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তু। বৈঠকে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা, যাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন সম্ভবত বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ, তাঁরা এই যুক্তি দেন যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার সময় এখনো আসেনি, এ ঘোষণা দিলে যে রক্তাক্ত সংগ্রাম শুরু হবে, জনগণকে সেই পথে এগিয়ে নেওয়ার আগে গণচেতনা সংগঠিত করতে হবে, সে জন্য আরও সময়ের প্রয়োজন। আসলে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া ও লড়াই করার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ক্ষমতা সম্পর্কে সেই সময় আওয়ামী লীগের নেতাদের ধারণা ছিল সামান্যই। আর এই অংশের সেনানিবাসগুলোতে সামরিক বাহিনীর যেসব বাঙালি সদস্য ছিলেন, সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হলে তাঁদের ভূমিকা কী হতে পারে, সে ব্যাপারেও আওয়ামী লীগের নেতারা তখন নিশ্চিত ছিলেন না।
আওয়ামী লীগের অপেক্ষাকৃত জ্যেষ্ঠ নেতাদের সংশয়ের বিপরীতে সিরাজুল আলম খানের (‘কাপালিক সিরাজ’ নামে পরিচিত ছিলেন) মতো তরুণ নেতারা একটা সর্বাত্মক স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা জাগাতে সেদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। ৭ মার্চের জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার আগে আমি ও নুরুল ইসলাম গাড়ি চালিয়ে ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের ইকবাল হলে যাই তরুণ প্রজন্মের মনের অবস্থা বোঝার জন্য। সেখানে ঘটনাক্রমে আমাদের দেখা হয় কাপালিকের সঙ্গে, তাঁকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তিনি আমাদের এমন আভাস দিলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারণের মতো নাটকীয় কিছুর প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। পরে যেমনটি দেখা গেল, বঙ্গবন্ধু তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারী ভাষণটি দেন সেই দিন। সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারণ না করেই তিনি পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেন যে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিবেদনের জন্য বাঙালিদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ফলে আলোচনার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের পথ বা অন্ততপক্ষে আইনগত দিক থেকে না হলেও সারবত্তার দিক থেকে একধরনের স্বাধীনতা অর্জনের পথ খোলা রইল।
ওপরে আলোচিত বিষয়গুলোর কিছু কিছু আমি লিখিতভাবে তুলে ধরেছিলাম ফোরাম পত্রিকায়, ১ মার্চের আগের উত্তেজনাময় সময়ে। আমার লেখার মূল কথা ছিল, পাকিস্তানের বর্তমান সংকট মোকাবিলার একমাত্র পথ হচ্ছে ছয় দফার বাস্তবায়ন। সেটা করলে কী হবে তা-ও আমি বিস্তারিতভাবে বলার চেষ্টা করেছি। আর তা না হলে সংগ্রাম ও স্বাধীনতার পথই বেছে নেবে বাঙালি। বাঙালিদের মধ্যে তখন আর পাকিস্তানপ্রেমের অবশিষ্ট কিছু ছিল না, কিন্তু তখন বিষয়টা ছিল এ রকম: বাঙালিদের বেরিয়ে যাওয়া কি সাংবিধানিক উপায়ে হবে, নাকি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
আমার মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যেদিন ইয়াহিয়া খান গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন, সেদিনই আসলে আমাদের ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ, সেদিনই আমরা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করি।
অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ফলে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সেদিন থেকে পাকিস্তানের কর্তৃত্ব শেষ হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আর কখনো এই কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। আর ২৬ মার্চের পর তারা কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করতে যে নৃশংসতা শুরু করল, বাঙালিরা সেটাকে বিদেশি শক্তির আগ্রাসন হিসেবে দেখল।
বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক সর্বাত্মকভাবে সফল হওয়ায় দেশের বেসামরিক ও অর্থনৈতিক সেবায় সংকট সৃষ্টি হয়। শ্রমিক, পুলিশ থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্যন্ত সবাই যখন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিল, তখন আসলে আক্ষরিকভাবেই সেনানিবাসের বাইরে পাকিস্তানের শাসনের অস্তিত্ব ছিল না। ফলে এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন টিকিয়ে রাখতে হলে এই শূন্যতা কাটাতেই হতো। অর্থাৎ ইয়াহিয়া খান ৫ মার্চ জেনারেল ইয়াকুবের কথা মেনে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিলে বঙ্গবন্ধুকেই দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে হারার পর থেকে বাঙালির জীবনে এই সময় আর আসেনি।
১৯৭১ সালের ৫ মার্চ সেনানিবাসগুলোর বাইরে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে সেনাশাসিত পাকিস্তানের সার্বভৌম সরকারের কর্তৃত্ব বঙ্গবন্ধুর হাতে চলে আসে। এটা এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে একালের রাজনীতিকদের তর্কবিতর্ক অর্থহীন হয়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার আনুষ্ঠানিক তারিখ যা-ই হোক না কেন, সেই ঘোষণা বঙ্গবন্ধু বা যে-ই দিয়ে থাকুন না কেন, বাংলাদেশ কার্যত স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ, যেদিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব চলে আসে বঙ্গবন্ধুর হাতে। ওই তারিখের পর থেকে ইয়াহিয়া যা-ই করেছেন, বাংলাদেশের মানুষ তা সার্বভৌম দেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আগ্রাসন হিসেবেই দেখেছে। বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে জাতীয় সচেতনতার এই অভ্যুদয়ের প্রতিফলন ঘটেছে ২৫ মার্চের ঘটনাবলির প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়ায়।
লেখকের আত্মজীবনী আনট্র্যাঙ্কুইল রিকালেকশন্স: দ্য ইয়ার্স অব ফুলফিলমেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত।
আগামীকাল দ্বিতীয় পর্ব : দুটি বাড়ি ছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক সচিবালয়
রেহমান সোবহান: অর্থনীতিবিদ। চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
স্বাধীনতার মাস
দুটি বাড়ি ছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক সচিবালয়
রেহমান সোবহান
ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সেই বাড়িটিসরকারি কর্তৃত্ব যখন কার্যত বঙ্গবন্ধুর হাতে চলে আসে, তখন অর্থনীতি সচল রাখতে তাঁকে প্রতিদিনই নানা রকমের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে হতো। সমস্যাগুলোর মধ্যে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে রেমিট্যান্স পাঠানোর ওপর এক্সচেঞ্জ কন্ট্রোল আরোপ করা, পশ্চিম পাকিস্তানের টাকশাল থেকে টাকা আসা বন্ধ হওয়ায় নগদ টাকার স্বল্পতা, রপ্তানিনীতি ও প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির মূল্য পরিশোধের মাধ্যম নির্ধারণ প্রভৃতি, যেগুলোর সমাধান বের করা জরুরি ছিল।
এই সমস্যা মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেনকে দায়িত্ব দেন, তাঁদের সঙ্গে অর্থনীতিবিদেরা তো ছিলেনই। তাঁরা আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁরা কখনো ধানমন্ডিতে নুরুল ইসলামের বাড়িতে বসতেন, কখনো সার্কিট হাউস রোডে কামাল হোসেনের বাড়িতে বসতেন। এ দুটি বাড়ি হয়ে ওঠে শেখ মুজিব সরকারের অর্থনৈতিক সচিবালয়। সেখানে তাঁরা প্রতিদিন আমলা, ব্যবসায়ী নেতা ও ব্যাংকারদের সঙ্গে বসে সুনির্দিষ্টভাবে বিভিন্ন সমস্যার পর্যালোচনা করতেন। তাঁরা নানা আদেশ ও নির্দেশনা দিতেন, যেগুলো ব্যবসায়ী, আমলাসহ সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। তাঁরা সেখান থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও দিতেন। কোনো কোনো দিন কামাল হোসেন, কোনো দিন তাজউদ্দীন আহমদ ৩২ নম্বর বা কামাল হোসেনের বাসা থেকে এসব নির্দেশনা দিতেন।
স্থানীয় অর্থনীতির সমস্যা মোকাবিলা করার পাশাপাশি অর্থনীতিবিদদের আরেকটি কাজ ছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মুখোমুখি হওয়া। প্রথিতযশা ও গুণী বিদেশি সাংবাদিকেরা প্রতিদিন নুরুল ইসলামের বাড়িতে আসতেন। তাঁদের মধ্যে অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকও ছিলেন, যেমন দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর টিলম্যান, পেগি ডারডিন, সিডনি শনবার্গ, দ্য গার্ডিয়ান-এর পিটার প্রিস্টন, মার্টিন উলাকোট, মার্টিন অ্যাডিনি, দ্য টাইমস-এর পিটার হ্যাজেলহার্স্ট, দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সাইমন ড্রিং, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সেলিগ হ্যারিসন প্রমুখ। এঁদের মধ্যে সিডনি শনবার্গকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিষয়ক প্রতিবেদনের জন্য পাকিস্তান সরকার দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল, যার জন্য তিনি পুলিৎজার পুরস্কার প্রায় পেয়ে যাচ্ছিলেন। আর পিটার প্রিস্টন পরবর্তীকালে দ্য গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকও হয়েছিলেন। সাইমন ড্রিং, উলাকোট, সিডনি শনবার্গের মতো অভিজ্ঞ সাংবাদিকেরা শুধু পেশাগত কাজের জন্য নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে আবেগের সম্পর্কে বাঁধা পড়ে প্রতিবেদন করে গেছেন। আরেকজনের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন দ্য সানডে টাইমস-এর নিকোলাস টমালিন, যিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ কাভার করে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। কেমব্রিজে এক অনানুষ্ঠানিক বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধসহ অনেক রাজনৈতিক ঘটনার সংবাদ তিনি করেছেন, কিন্তু বাংলাদেশের মতো আর কোনো দেশের সঙ্গে তিনি এতটা আবেগের সম্পর্কে বাঁধা পড়েননি।
এরপর আমি যখন লন্ডনে প্রচারণা চালিয়েছি, তখন চাওয়ামাত্র তাঁরা আমাকে তাঁদের প্রতিবেদন ও কলামের কপি দিয়ে সাহায্য করেছেন। ফলে আমি দ্য টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, নিউ স্টেটসম্যান, নিউ রিপাবলিক ও দ্য নেশন পত্রিকায় লিখতে পেরেছি। এমনকি তাঁরা আমাদের পাকিস্তানি শাসক চক্রের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন খবরাখবর দিয়েও সহায়তা করেছেন। পিটার হ্যাজেলহার্স্ট মার্চে কামাল হোসেনের বাড়িতে চা খেতে খেতে আমাকে বলেছিলেন, ভুট্টো মনে করেন, বাংলাদেশিদের এই আন্দোলন আসলে শহরের কিছু শিক্ষিত মানুষের কারসাজি, যাঁরা সশস্ত্র সংগ্রাম সম্পর্কে কিছুই জানেন না। সেনাবাহিনী তো কিছু মানুষকে মেরেছে, আর কিছু মানুষকে জেলে পুরলে ও ভয় দেখালেই তা শেষ হয়ে যাবে।
যা-ই হোক, আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ওই সময় নুরুল ইসলামের বাড়ি বিদ্রোহী সরকারের ঘাঁটিতে পরিণত
হয়, সামরিক কর্তারাও এই বাড়িকে দেশদ্রোহী কাজের ডেরা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর কারণ হচ্ছে, নুরুল ইসলামের নিকট আত্মীয় (ব্রাদার–ইন–ল) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্নেল ইয়াসিন ও টিঅ্যান্ডটির এস হুদা সেখানে যেতেন। কর্নেল ইয়াসিনের ওপর ঢাকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর খাদ্য সরবরাহের ভার ছিল। এই খবর আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে চলে যায়, ফলে তাঁরা কিছু সরবরাহকারীকে চাপ দিয়ে এই জোগান বন্ধ করতে প্ররোচিত করেছিলেন। এই কৌশল বেশ কাজে লেগেছিল। জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার স্মৃতিকথায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
এর পরিণতি ছিল ভয়ংকর। ২৫ মার্চের আক্রমণের পর কর্নেল ইয়াসিন ও হুদা দুজনকেই সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। ইয়াসিনকে লাহোরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়, আর হুদার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে চক্রান্ত করে ভারতের সঙ্গে গোপন টেলিযোগাযোগ স্থাপন করেছেন। ইয়াসিনকে জোর করে বঙ্গবন্ধু ও ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে হরতালের কারণে ঢাকা নগরে যানবাহনের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তবে ফোরাম-এর সম্পাদক হওয়ায় আমার ভকসওয়াগনের কাচে সাংবাদিকের স্টিকার লাগানো ছিল, এতে করে আমি বেশ স্বাধীনভাবেই ঘুরতে পারতাম। ফলে আমি দিনের সময়টা সম্পাদক, অর্থনীতিবিদ ও প্রতিবেদক—এভাবে ভাগ করে নিতে পারতাম, সব ভূমিকায়ই আমাকে কাজ করতে হতো। ফলে ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত আমি ও হামিদা হোসেন ফোরাম-এর খুবই ভালো কিছু সংখ্যা বের করতে পেরেছিলাম।
বঙ্গবন্ধু যতক্ষণ বাংলাদেশের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলেন, ততক্ষণ আওয়ামী লীগের কর্মী ও আমজনতা নিজে থেকেই আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখেছে। সাধারণ মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় এটা সম্ভব হয়েছিল। তবে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় অবাঙালিদের ওপর হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। এর সংখ্যা খুব বেশি ছিল না, কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেটাই অতিরঞ্জিত করে বাঙালিদের কচুকাটা করার যুক্তি দিয়েছে।
কথা হচ্ছে, অবাঙালিদের দুঃখ-কষ্ট সইতে হয়েছে, তা সে যে মাত্রায়ই হোক না কেন। কিন্তু ১ মার্চের পর থেকে অবস্থাপন্ন অবাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতে শুরু করে। একসময় আওয়ামী লীগের নেতারা এই ভেবে শঙ্কিত হন যে তারা হয়তো অস্থাবর সম্পত্তি যেমন টাকা ও গয়না নিয়ে চলে যাচ্ছে। ফলে আওয়ামী লীগের কিছু স্বেচ্ছাসেবী নির্দেশনা ছাড়াই বিমানবন্দর অভিমুখী গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করতে শুরু করেন। এ কারণে আওয়ামী লীগের প্রশাসন বাধ্য হয়ে নির্দেশনা জারি করে, এসব বন্ধ করতে হবে। কারণ এতে অবাঙালিদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার খবর আগুনে ঘি ঢেলে দেয়।
খবর আসে, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন কাঠের ডামি রাইফেল নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আরও শুনলাম, বিভিন্ন দপ্তরের সশস্ত্র রক্ষীদের পয়েন্ট ৩০৩ রাইফেল চুরি হয়েছে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের পরীক্ষাগার থেকে রাসায়নিক পদার্থ খোয়া গেছে। কিন্তু এসব শৌখিন কাজে মানুষের মনে এই আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়নি যে আমরা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত।
ওদিকে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সহকর্মী আনিসুর রহমান শিল্পী কামরুল হাসানকে নিয়ে আমাদের চেতনা উজ্জীবিত রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপার্টমেন্টে গণসংগীতের আসর বসান। আনিসুর ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালানো হবে। সে কারণে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বন্ধুদের চিঠি লিখে আহ্বান জানান, তাঁরা যেন এর বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশে জনমত তৈরি করেন।
১৯৭১ সালের মধ্য মার্চে ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমনের কারণে মনে হয়েছিল, সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে যাচ্ছে। কিন্তু ভুট্টোর আসার পর অনেকেই মনে করেছিলেন, তাঁর কাজই হচ্ছে মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার সম্ভাবনা নস্যাৎ করা। তাঁরাই ঠিক ছিলেন।
লেখকের আত্মজীবনী আন ট্র্যাঙ্কুইল রিকালেকশন্স: দ্য ইয়ার্স অব ফুলফিলমেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত। (শেষ)
রেহমান সোবহান: অর্থনীতিবিদ। চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।