দেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে – ফাহমিদা খাতুন

Published in বণিকবার্তা on Monday, 1 October 2018

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে শ্রমবাজারে তাদের উভয়ের অংশগ্রহণ সমান হারে হতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ আগের দশকগুলোর তুলনায় বাড়ছে। এ অংশগ্রহণ শুধু সনাতন খাত, যেমন— কৃষি বা গৃহস্থালি কাজের মধ্যেই নয় কিংবা শুধু তৈরি পোশাক শিল্পেই নয়, অনেক নতুন উদীয়মান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীরা কাজ করছেন। যদিও পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার এখনো অনেক কম।

বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার ফলে কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমে শিল্প ও সেবা খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৫২ দশমিক ১ শতাংশ আসে সেবা খাত থেকে, শিল্প খাত থেকে আসে ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ আর কৃষি খাত থেকে আসছে মাত্র ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। প্রায় দুই দশক আগে অর্থাৎ ২০০০ সালে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ২১ দশমিক ৩ শতাংশ। আর শিল্প ও সেবা খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ২২ দশমিক ৯ ও ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ। কর্মসংস্থানের উৎসগুলোতে দেখা যায়, অর্থনীতিতে কৃষির অবদান কমে এলেও কর্মসংস্থানের মূল ক্ষেত্রটি এখনো কৃষি খাত। ২০০০ সালে কৃষি খাতে মোট কর্মসংস্থানের ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ সৃষ্টি হতো; শিল্প খাতে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ ও সেবা খাতে ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রম জরিপ ২০১৬-১৭ অনুযায়ী, বর্তমানে মোট শ্রমশক্তির ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ কৃষিতে, ২০ দশমিক ৪ শতাংশ শিল্পে আর ৩৯ শতাংশ সেবা খাতে নিয়োজিত। অর্থাৎ অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে কর্মসংস্থানের কাঠামোতেও পরিবর্তন এসেছে। এটি নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই সত্য।

শ্রমবাজারে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণের হার তুলনা করলে দেখা যায়, নারীরা এখনো শ্রমবাজারে অনেক কম সংখ্যায় আসছে। দশক অনুযায়ী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০০০ সালে নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১০ সালে ৩৬ শতাংশ হয়েছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে তা কমে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছে। কিন্তু পুরুষের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার ২০১৬-১৭ সালে ৮০ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। পুরুষের ক্ষেত্রে অবশ্য ২০০৩ সাল থেকে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার ক্রমে কমে আসছে। বাংলাদেশের নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের চিত্রটি আরেকটু খতিয়ে দেখলে লক্ষ করা যায়, ১৫-২৯ বছর বয়স্ক নারীর ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশের শিক্ষা, কর্মসংস্থান কিংবা প্রশিক্ষণ কোথাও নেই। অর্থাৎ তারা ঘরের ভেতরে সাংসারিক কাজে নিয়োজিত। একই বয়সের পুরুষের ক্ষেত্রে এ হার ৮ দশমিক ১ শতাংশ। তাই শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তা পুরুষের তুলনায় অনেক কম। তদুপরি অসংগঠিত খাতে নিয়োজনের পরিমাণ অনেক বেশি। শ্রম জরিপ ১৯৯৯-২০০০ অনুযায়ী, মোট শ্রম নিয়োজনের ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ অসংগঠিত খাতে নিয়োজিত ছিল, যেখানে নারীদের পরিমাণ ছিল ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রায় দেড় দশক পর ২০১৬-১৭ সালের শ্রম জরিপে অসংগঠিত খাতে শ্রম নিয়োজনের অংশ সামান্য কমে ৮২ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে। এর মধ্যে নারীদের ৯১ দশমিক ৮ শতাংশ অসংগঠিত খাতে নিয়োজিত।

খাতওয়ারি ভাগ করে দেখলে প্রতীয়মান হয়, কৃষি খাত এখনো নারী শ্রম নিয়োজনের প্রধান জায়গা। নারী শ্রম নিয়োজনের ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ হচ্ছে কৃষি খাত, ৫ দশমিক ২ শতাংশ শিল্প খাতে এবং ৭ দশমিক ২ শতাংশ সেবা খাতে। শিল্প খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে ২০১৩-১৭ সালের মধ্যে মোট নারী শ্রমিক নিয়োজনের সংখ্যা কমে গেছে। এটি উদ্বেগজনক। কেননা তৈরি পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকদের একটি বিশাল অংশ নিয়োজিত। আশির দশকে যখন তৈরি পোশাক শিল্প খাতটি বাংলাদেশে বিকশিত হতে থাকে, তখন এ খাতে মোট শ্রমিকের প্রায় ৮০ শতাংশই ছিল নারী শ্রমিক। সিপিডির সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, তৈরি পোশাক শিল্প খাতে নারী শ্রমিকের অংশ কমে ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েছে ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১২ সালে এ অংশ ছিল ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে পোশাক খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং নারী শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা না থাকাকে প্রধান কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে পুশ ফ্যাক্টর এবং পুশ ফ্যাক্টরের মধ্যে কোনটি কতখানি কাজ করছে, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

কাজের ঘণ্টা হিসাব করলে দেখা যায়, নিয়মিত বেতনভুক্ত কাজে নারীরা পুরুষের তুলনায় কম কাজ করছে। এর কারণ মূলত মেয়েদের বেতনহীন গৃহস্থালি কাজে অনেক সময় দিতে হয়। সিপিডির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে নারীরা গড়ে ৭ দশমিক ৭ ঘণ্টা বেতনহীন ঘরের কাজে ব্যয় করে। আর পুরুষরা ব্যয় করে মাত্র ২ দশমিক ৫ ঘণ্টা। শ্রমবাজারে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও দৈনিক মজুরির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য আগের তুলনায় উন্নতি হয়েছে, অর্থাৎ মজুরিবৈষম্য সামান্য কমেছে।

গত দুই দশকে নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের চিত্রটি বিভিন্নভাবে দেখা যায়। বেশিসংখ্যক নারী ঘরে-বাইরে বেতনভুক্ত কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছে। ফলে তাদের মধ্যে বেকারত্ব ও অর্ধবেকারত্বের হার কমে আসছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারীর কাজের সুযোগ ও চাহিদা দুটোই বেড়েছে। সেই সঙ্গে নারীশিক্ষার হার বাড়ছে এবং উচ্চশিক্ষায়ও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তবে কিছু আবশ্যকীয় কারণ এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমে বাড়ছে। একক আয়ে পারিবারিক চাহিদাগুলো মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই নারীরা কম আয়ের কাজ হলেও সেগুলোয় নিয়োজিত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বল্প আয়ের এবং নীচু পর্যায়ের কাজগুলোয় অংশ নিচ্ছে। তৈরি পোশাক খাত থেকে শুরু করে প্রশাসনিক, ব্যবস্থাপনা, করপোরেট খাত ইত্যাদির বেলায়ও এটি লক্ষণীয়।

বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিময়তা বজায় রাখতে হলে নারীদের কর্মসংস্থানের হার বাড়াতে হবে। জনসংখ্যার ¬অর্ধেক অংশকে উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে না পারলে প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। এ নারীদের একটি বড় অংশ হচ্ছে তরুণ ও কর্মক্ষম। তাদের শ্রমবাজারে আনতে হলে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতে বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক উদ্যোগ নিতে হবে। নারীদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি সামগ্রিক অর্থনৈতিক নীতিমালার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়লেও তা যথেষ্টসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে না। আর কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি হলে তা নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। নারীদের উচ্চশিক্ষিত করতে হবে এবং এর সঙ্গে তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রমবাজারের জন্য দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে মেয়েদের অংশগ্রহণের হার ছেলে শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি হলেও শিক্ষার পরবর্তী ধাপগুলোয় মেয়েদের অংশ ক্রমে কমে আসে।

নারীদের জন্য দেশব্যাপী আরো বেশিসংখ্যক কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। সেগুলোয় তারা যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে, সেজন্য নিরাপদ থাকা ও চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মরত নারীদেরকে প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিতে হবে নিয়োগকারীদের। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বেশি আয়ের কাজগুলোয় নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারছে না বলে তাদের আয় বাড়ছে না। অন্যদিকে কৃষি খাতের অবদান কমে আসার কারণে কাজের সুযোগও কমে আসছে। সেখানে প্রথমে নারীরাই সেই সুযোগটি হারাচ্ছে। গ্রামীণ অকৃষিজ অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। স্ব-নিয়োজিত নারীদের সংখ্যাও বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় এক-চতুর্থাংশ নারী নিজেই কোনো উদ্যোগ নিয়ে আয় বর্ধনকারী কাজে নিয়োজিত। তাদের ও নতুন নতুন নারী উদ্যোক্তাকে মূলধন ও অন্যান্য নীতি সহায়তা দিতে হবে। সংগঠিত ও উচ্চ আয়ের পেশাগুলোয় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং তাদের ধরে রাখার জন্য ব্যক্তি খাতকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। নিয়োগকারীদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। আগামী দিনের অর্থনীতি হবে আরো বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। সেখানে অনেক ধরনের শ্রমের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে। যাদের দক্ষতা থাকবে না, তারা শ্রমবাজার থেকে ঝরে পড়বে। নারীদের জন্য এটি হবে বিশেষ উদ্বেগের বিষয়, যেহেতু তারা প্রযুক্তিগত দক্ষতায় পিছিয়ে রয়েছে। তাই তাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যেমন— অর্থ, পরিকল্পনা, মহিলা শিক্ষা, শ্রম, শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, পরিবহন, আইন— সবাইকে একসঙ্গে সংহত হয়ে নীতিমালা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সঠিক নীতিমালা, যথোপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও মানব উন্নয়ন ব্যয় বাড়াতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা ক্রমে বাড়ছে। কিন্তু এখনো যথেষ্ট নয়। একে এগিয়ে নিতে হবে উপযুক্ত অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিকাঠামো তৈরির মাধ্যমে। কেননা বৈষম্য শুধু আয় বাড়ানোর মাধ্যমেই ঘোচানো যায় না। পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে উন্নত মননশীলতা তৈরি না হলে অর্থনীতিতে নারীর অবদান বাড়ানো সম্ভব নয়।

 

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)