দুর্নীতিতে অর্থনীতি বিপর্যস্ত, প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তি ও সুশাসন – ফাহমিদা খাতুন

বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অভিমত

Originally posted in প্রথম আলো on 26 July 2025

সরকার ও রাজনৈতিক দলে সংস্কারে গুরুত্ব দিতে হবে

বিগত দিনে উন্নয়ন কৌশলে ভুল ছিল। দুর্নীতি, দুঃশাসন, ক্ষমতা কুক্ষিগত করা এবং তথ্য বিকৃতির কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সর্বত্র জনগণ উপেক্ষিত ছিল। এ কারণে উন্নয়নের বয়ান শোনা গেলেও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি সম্ভব হয়নি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, সুশাসন ও অন্তর্ভুক্তিকরণে গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য সরকার, রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংস্কারে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে।

‘অর্থনীতি, শাসন ও ক্ষমতা: যাপিত জীবনের আলেখ্য’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন সরকারের প্রতিনিধি, রাজনীতিক ও গবেষকরা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বইটি রচনা করেছেন।

গতকাল শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এ ছাড়া বক্তব্য দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিশিষ্টজন। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এতে সভাপতিত্ব করেন।

সুশাসন ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়–সালেহউদ্দিন আহমেদ

অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দেশকে শোষণ করা সহজ, শাসন করা সহজ নয়। সুশাসন এবং উন্নয়নের রাজনীতি ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। সুশাসন অনেক কঠিন। প্রধানমন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের ক্ষমতার ভারসাম্য নেই। এতে সংস্কার না হলে অন্যান্য ক্ষেত্রে যত সংস্কারই করা হোক না কেন, তাতে কোনো লাভ হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সংস্কার দরকার।

বিগত দিনে উন্নয়ন দর্শন সম্পর্কে উপদেষ্টা বলেন, শাসন ও উন্নয়নের সমস্যা আছে। উন্নয়ন কৌশলে ভুল ছিল। এখন যে খুব সঠিক আছে, তাও নয়। তবে সরকার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, গত বছরের আগস্টে যখন এই সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন দেখা গেছে এ রকম অবস্থা বিশ্বে কোথাও নেই। অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়েছে। ব্যাংক খাতের ৮০ শতাংশ অর্থ নিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, অর্থনীতি পুনর্গঠনে ৩৫ বিলিয়ন ডলার লাগবে। তবে আইএমএফ প্রাথমিক হিসাবে বলেছিল, ১৮ বিলিয়ন ডলার লাগবে। খাদের কিনারে থাকা অর্থনীতিকে উদ্ধার করার চ্যালেঞ্জ ছিল। ভালো প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। আইনের ব্যত্যয় হয়েছে এবং প্রক্রিয়াগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। সেই মানুষগুলোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে, ধমক দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে।

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ব্যবসায়ীরা এই উত্তরণকে চ্যালেঞ্জ বলছেন। ৫০ বছর ধরে লালন করার পরও এখন বলেন তারা শিশু। তাদের এলডিসি উত্তরণের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।

সংস্কারের বিষয়টি অ্যান্টিবায়োটিক নয়– মির্জা ফখরুল

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সংস্কার রাতারাতি হয় না। মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। রাজনৈতিক দলও সমাজের বাইরে নয়। পরিস্থিতি বোঝাতে তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে ১১ বার জেলে গেছেন তিনি। ৬০ হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে। তাদের প্রতিদিন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। দেশে প্রথম গুম করা হয় ইলিয়াস আলীকে। রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে। লুটপাট হয়েছে। কোথাও কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। তিনি বলেন, সংস্কারের বিষয়টি এমন নয়, অ্যান্টিবায়োটিকের মতো দিলাম আর সব ঠিক হয়ে যাবে। গণতন্ত্রের চর্চা বাদ দিয়ে চাপিয়ে দেওয়া কোনো কিছু দিয়ে সংস্কার হয় না।

বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, দেশের শীর্ষ একজন ব্যবসায়ী তাঁর কাছে অভিযোগ করেছেন, আগে ঘুষ দিতে হতো এক লাখ টাকা; এখন দিতে হয় পাঁচ লাখ। কোথাও সুশাসন নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই। পুলিশে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এ জন্য কোনো রকম বিলম্ব না করে অতিদ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের প্রতিনিধিকে সংসদে পাঠিয়ে সংস্কার করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নতুন শুল্ক আরোপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ আমাদের বড় বিপদে ফেলতে পারে। মনে রাখা দরকার, রাজনৈতিক দল দেশের উন্নয়নে জনস্বার্থে সব সময় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।

ক্ষমতার কলুষিত মডেল বিতাড়িত করতে হবে: হোসেন জিল্লুর

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অর্থনীতি, শাসন ও ক্ষমতার আন্তঃক্রিয়া– এ তিনটির সম্মিলনই দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের মানুষ শত প্রতিকূলতার মুখেও আবার জেগে ওঠে। তবে গত ১৫ বছর কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হলো, যা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করেছে। শাসন, ক্ষমতা ও স্বৈরতন্ত্র অর্থনীতির কর্মকাণ্ডে গেড়ে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত তরুণদের প্রচেষ্টায় তার অবসান হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সমাজ নির্মাণ এবং সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের উপলব্ধি থেকে বইটি রচনা করেছেন তিনি। নীতি শাসনে যাপিত জীবনের প্রভাব আছে কিনা, ঘাটতি কোথায়– সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে বইটিতে। ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বইটি লেখা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, পরিবর্তন ঘটানো শুধু অন্তর্বর্তী সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নয়। সব জায়গায় সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। ক্ষমতার কলুষিত মডেল বিতাড়িত করতে হবে।

‘সর্বত্র জনগণ উপেক্ষিত ছিল’

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, অর্থনীতি, শাসন ও ক্ষমতা– এসব উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এগুলোর সমন্বয়ে শক্তিশালী কাঠামো গড়ে না উঠলে উন্নয়ন টেকসই হয় না। গত দেড় দশকে রাজনীতিক, দুষ্টু ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্র– এ চক্রই অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। মেগা প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বিদ্যুৎ-ব্যাংকিং খাতসহ সব আর্থিক খাতে দুর্নীতি হয়েছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, তথ্য বিকৃতি, দুর্নীতি– এসব কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সর্বত্র জনগণ উপেক্ষিত ছিল। এ কারণে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি সম্ভব হয়নি। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, সুশাসন ও অন্তর্ভুক্তিকরণে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, অর্থনীতি আগে, না ক্ষমতা– এ প্রশ্ন বহু পুরোনো। ডিম আগে, না মুরগি আগে– সেই বিতর্কের মতোই। কিন্তু ইতিহাসজুড়েই দেখা যায়, ক্ষমতা সব সময় শ্রেণিভিত্তিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠানে এ ছাড়া বক্তব্য দেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির, লেখক ও রাজনীতি বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ, আলোঘর প্রকাশনার প্রকাশক সহিদ উল্লাহ, গবেষক খন্দকার শাখাওয়াত আলী, ভূঁইয়া আসাদুজ্জামান প্রমূখ।