Originally posted in বণিকবার্তা on 20 November 2023
ড. মসিউর রহমান এবং আমি, আমরা দুজনেই ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ অনার্স ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম। সহপাঠী হলেও সে সময় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কথা বলা কিংবা তর্ক-বিতর্ক করার তেমন সুযোগ ছিল না। প্রায় সময়ই আমরা মেয়েরা থাকতাম মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট কমনরুমে। কেবল ক্লাসের সময় বাইরে আসতাম। অবশ্য ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কম থাকায় আমরা সবাই একজন আরেকজনকে চিনতাম। ড. মসিউর রহমান ছিলেন ইংরেজি বিভাগে এবং আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। এমএ পরীক্ষার পর ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকারের স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে আমি হার্ভার্ডে পড়তে যাই। পূর্ব পাকিস্তান থেকে তখন আমরা মাত্র পাঁচজন নির্বাচিত হই। আমার যতদূর মনে পড়ে ড. মসিউর রহমানও সেখানে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে সিএসপি হয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।
তারপর তার সঙ্গে দেখা হয় ১৯৭৮ সালে। তখন ড. মসিউর রহমান টাফটস ইউনিভার্সিটি এবং হার্ভার্ডে পড়াশোনা করছিলেন। আর ১৯৭৮ সালে একটা গবেষণার জন্য আমি কিছুদিন বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে ছিলাম। সে সময় ড. মসিউর রহমান ও তার পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। বলা যায় আমাদের মধ্যে প্রথম কথাবার্তা তখনই হয়েছে। তারপর তাকে চিনেছি প্রধানত লেখার মাধ্যমে এবং আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে আয়োজিত বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে।
ড. মসিউর রহমান সারা জীবনই একজন দক্ষ আমলা হিসেবে কাজ করেছেন। অর্থনৈতিক মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগে তিনি কাজ করেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেন। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্য রিপোর্টও তৈরি করেছেন।
তবে তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি গুণ হচ্ছে যে তিনি একই সঙ্গে সরকারি আমলার কাজ ও একাডেমিক কাজ করেছেন। খুব কমসংখ্যক মানুষই দুটো কাজ একসঙ্গে চালিয়ে যেতে পারেন। অনেকেই পিএইচডি ডিগ্রি করার পর আর লেখালেখি করেন না। কিন্তু ড. মসিউর রহমান সারা জীবনই লেখালেখির কাজ অব্যাহত রেখেছেন তার বেশির ভাগ লেখা অর্থনীতির ওপরে। ১৯৮৭ ও ১৯৯৪ সালে ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে অর্থনীতির ওপর তার দুটি বই প্রকাশিত হয়। অবশ্য আমার সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে মূলত তার রাজনীতির ওপর লেখা বই নিয়ে। ২০০৮ সালে তার লেখা ডেমোক্রেসি ইন ক্রাইসিস বইটি প্রকাশ করে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। বইটি প্রকাশনা উৎসবে তিনি আমাকে আলোচক হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বইটিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা ও সংস্কার নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এসব বিতর্কিত বিষয়বস্তু ছাড়াও তিনি কিছু তাত্ত্বিক আলোচনা সংযুক্ত করেছেন। এ বইটির বিষয়গুলো নিয়ে আরো আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হতে পারে বলে আমি মনে করি।
ড. মসিউর রহমান সবসময়ই সহপাঠীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পছন্দ করেন। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা একসঙ্গে পড়েছিলাম তাদের মধ্যে আমরা মেয়েরা প্রথমে একটা চা-চক্রের নিয়মিত আয়োজন শুরু করেছিলাম। পরে আমাদের সঙ্গে সহপাঠী ছাত্রদেরও যুক্ত করি। সেই সুবাদে ড. মসিউর রহমান, ড. সামাদ, ড. আহবাব, ড. মিজানুর রহমান শেলী, মাহবুব তালুকদার, ওয়ালিউল ইসলাম, জাহাঙ্গীর জসিম এবং অন্যদের সঙ্গেও আমাদের সামাজিক যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। ড. মসিউর রহমান প্রায় ১৫ বছর আগে আমেরিকান অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং এখনো সভাপতি হিসেবে সেই অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন।
সাধারণত যখন কোনো ব্যক্তি আমলা হন কিংবা সারা জীবন উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন তখন তাদের মধ্যে একটা অহমিকা দেখা যায়, কিন্তু ড. মসিউর রহমানের ব্যবহারে কখনো আমি অহমিকার বহিঃপ্রকাশ দেখিনি। মনে পড়ে বণিক বার্তার একটি অনুষ্ঠানে তিনি যখন লম্বা সময় নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করছিলেন দর্শকরা হাততালি দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল। বিষয়টিকে তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করেছিলেন এবং বলেছিলেন তিনি থামবেন না, আলোচনা চালিয়ে যাবেন। ড. মসিউর রহমানকে সবসময় দেখেছি অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে। তার ব্যবহার সবার সঙ্গে অত্যন্ত চমৎকার।
২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে ড. মসিউর রহমান প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। একসময় তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। নতুন নীতি প্রণীত হয়েছে, চুক্তি হয়েছে; যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের অনেক উন্নতি হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে একদিন ড. মসিউর রহমান আমাকে বলেছিলেন যে ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন ও বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব অংশের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গতিশীল করাটাকে দেখতে হবে বাংলাদেশের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে। আমরা কী দিচ্ছি এবং ভারত কী দিচ্ছে, এভাবে ছোটখাটো বিষয়ে দরকষাকষির চেয়ে দেখতে হবে আমাদের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি লাভ অর্জিত হচ্ছে কিনা। এতদিন ধরে তিনি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিশ্চয়ই অনেক ভালো উপদেশ দিয়েছেন। গত ১৫ বছরে দেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, তাতে ড. মসিউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আমি তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
ড. রওনক জাহান: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)