অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কাঠামোগত সংস্কার প্রাতিষ্ঠানিক ও মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়াতে হবে – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বণিকবার্তা on 2 June 2021

ড. ফাহমিদা খাতুন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেছেন। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে ডিস্টিংশন নিয়ে সম্পদ ও পরিবেশ অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এবং অর্থনীতিতে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটে পোস্ট-ডক্টরাল ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্বের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কাজ করেছেন বিআইডিএস, ইউএসএআইডি ও ইউএনডিপিতে। নরওয়ের ক্রিশ্চিয়ান মিকেলসন ইনস্টিটিউট, দক্ষিণ কোরিয়ার ইনস্টিটিউট ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিকস অ্যান্ড ট্রেড এবং ভারতের সেন্টার ফর স্টাডি অব সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড পলিসিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। আগামী বাজেটের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

আসন্ন বাজেটে কোন দিকগুলোয় জোর দেয়া উচিত বলে মনে করেন?

প্রথমত, করোনার অভিঘাত চলছে। আরো কতদিন চলবে তা একটা অনিশ্চিত বিষয়। তবে আমরা গত অর্থবছরের শেষের দিকে এসে ভাবছিলাম যে করোনার অভিঘাত থেকে হয়তো মুক্তি পাচ্ছি। কীভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুদ্ধার করব, তা নিয়ে চিন্তা করছিলাম। এখনো আমরা করোনার ধাক্কা অনুভব করছি। যেহেতু অনিশ্চিত আরেকটা ধাক্কা আসবে কিনা, তা বলা যাচ্ছে না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে একটা বাজেট তৈরি হচ্ছে। গত অর্থবছরে আমরা অর্থনীতিতে যে ধরনের ধাক্কা পেয়েছি, সেগুলোর চাপ এখনো বিদ্যমান রয়েছে। একদিকে সামষ্টিক অর্থনীতি দেখলে, মৌল অর্থনৈতিক সূচকগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ সঞ্চালন, এডিপি কর্মসূচির ব্যবহার, রফতানি, আমদানি, বৈদেশিক বাণিজ্য, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ প্রভৃতি সূচকে আমরা বেশ খারাপ অবস্থায় রয়েছি। কভিড শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যে নয়, মানুষের পুরো জীবনমানে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কভিডের প্রতিঘাতে সাধারণ মানুষ, নিম্ন আয়ের মানুষ, দরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে যারা অনানুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রয়েছে, তারা অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের কাজ-চাকরি চলে গেছে, আয় হারিয়েছেন। ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেশি। এ অভিঘাতটা তারা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এটা কাটাতে না কাটাতেই দ্বিতীয় অভিঘাত এসেছে। করোনার দ্বিতীয় বাজেট আরো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। সিপিডিসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, নতুন নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। তাদের আয় কমেছে। সুতরাং এ ধরনের একটি সংকটের মধ্যে অর্থনীতিতে কিছুটা  রিসেশনের মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের সংকটে মূল উদ্যোগ হচ্ছে সরকারি ব্যয় বাড়ানো। সরকারই এ সময়ে এগিয়ে আসে। কারণ এখানে ব্যক্তি খাত অসুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু  দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন খাতে সরকারি বরাদ্দ পর্যাপ্ত ছিল না, আবার যতটুকু বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, তা পুরোপুরি ব্যয়ও করা যায়নি। সেখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা রয়ে গেছে। কাজেই সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে, যাতে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। আরেকদিকে সরকারকে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষকে প্রত্যক্ষ সহায়তা দিতে হবে। দিতে হবে নগদ অর্থ ও খাদ্যসহায়তা। ভোগের মাধ্যমে সামষ্টিক চাহিদা সৃষ্টি হবে। তার জন্যই ব্যয় বাড়াতে হবে, বরাদ্দ বাড়াতে হবে। করোনা মহামারী যেহেতু আসলে একটি স্বাস্থ্য সংকট, করোনাসৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ প্রয়োজন। গত বছর আমরা দেখেছি সেখানে অর্থ বরাদ্দ বাড়েনি। চিরাচরিতভাবে আমরা দেখছি স্বাস্থ্য খাতে এমনিতেই বরাদ্দ কম। জিডিপির ১ শতাংশের নিচে থাকে। বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য এ স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে স্বাভাবিক  মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া সম্ভব নয়, গুণমানসম্পন্ন সেবা দূরে থাক। করোনার সময় হাসপাতাল, আইসিইউ শয্যা, অক্সিজেন, চিকিৎসক ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীর চাহিদা বাড়ায় এই স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ কীভাবে আমরা মোকাবেলা করব, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। করোনায় এক কঠিন সময় অতিক্রম করেছি। আমরা এ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিইনি। কিন্তু যা দেয়া হয়েছে, তার যথাযথ ব্যবহার করে স্বাস্থ্য খাতের অনেকখানি উন্নতি করা যায়। সুতরাং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ও তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা প্রথমটির সঙ্গে যুক্ত, তা হলো সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতা বাড়ানো। সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালী করা। আমরা  দেখেছি গত অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ আগের চেয়ে কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। এটা জিডিপির ৩ শতাংশের কাছাকাছি উন্নীত হয়েছে। তবে সেখানেও দেখা যাচ্ছে, সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধ ও আরো অনেক কিছু যোগ করা হয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে নিট পরিমাণ খুব একটা বাড়েনি। সেটিও আসলে বাড়ানো উচিত। আমার মতে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ অন্ততপক্ষে জিডিপির ৪ শতাংশ করা উচিত। কেননা কভিডের আঘাতে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা অনেক  বেড়েছে। তৃতীয়ত, আমরা অনেক আগে থেকেই একটা সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষার কথা বলে আসছিলাম। এটা থাকলে যারা সমস্যায় আছে তাদের সুরক্ষা দিতে পারতাম। আমাদের জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র তৈরি হয়ে আছে ২০১৫ সালে। কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এটা বাস্তবায়নের সময় এসেছে এখন। চতুর্থত, শিক্ষা খাতের দিকে নজরটা দিতে হবে। শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাড়ছে না। অনেক দিন ধরে মোটামুটি একই অবস্থায় রয়েছে। জিডিপির ২ শতাংশ। গত একটা বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে খুব বেশি। সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ না নিলে তা কাটিয়ে ওঠা অনেক কঠিন হবে। এমনকি পাঁচ  থেকে দশ বছর লেগে যেতে পারে। কারণ কভিডের সময়ে খুব সীমিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস হয়েছে। সবার প্রযুক্তি নেই, প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও  নেই। এ কারণে সীমিত কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইন ক্লাস করতে পারেনি। সুতরাং  শেখার ক্ষেত্রে যে ক্ষতিটা হয়ে গেল, তা পূরণের জন্য আরো বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বরাদ্দ বাড়াতে হবে এজন্য,  করোনা চলে গেলেও সবাই যে ক্লাসরুমে ফিরে যাবে তা নয়। করোনা এটাও শিখিয়ে দিল যে প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব। আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। কারণ প্রযুক্তিগত অবকাঠামোটা আমাদের নেই। কোনো সংকট দেখা দিলে অনলাইনে যাতে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারি, সেজন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কাজেই শিক্ষায় প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর জন্য ব্যয়টা দরকার। শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণের একটা প্রস্তুতি প্রয়োজন। শিক্ষার মডিউলগুলোও সেভাবে তৈরি করতে হবে। সুতরাং ব্যয়টা কিন্তু অনেক জায়গায় রয়েছে। এ কয়েকটি খাতে আমি মনে করি আসন্ন বাজেটে জরুরিভাবে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।

করোনাকালে বিভিন্ন দেশ সরকারি ব্যয় বাড়ালেও বাংলাদেশে খুব একটা বাড়ানো হয়নি। এটাকে কীভাবে দেখেন?

এক্ষেত্রে তাত্ক্ষণিক ও স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগগুলো যেমন নিতে হবে, তেমনি কাঠামোগত সমস্যা নিরসনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সেটিও উন্নয়নের জন্য দরকার। আসন্ন বাজেটে তাত্ক্ষণিক সমস্যায় নজর দিতে গিয়ে চিরাচরিত সমস্যাগুলো যেন মনোযোগের বাইরে না যায়, তা লক্ষ রাখতে হবে। সে কারণে ওই সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়েও আসলে লাভ নেই।  সেজন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, বরাদ্দ তো দিয়েছিলাম কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, যেমন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় তো খরচ করতে পারেনি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যেহেতু খরচ করতে পারে না, সেহেতু প্রকৃত খরচের ভিত্তিতে নতুন বরাদ্দটা আসে। এটা একটা দুঃখজনক বিষয়। করোনার বাজেট করতে গিয়ে নীতিনির্ধারকদের অনুভব করা উচিত কাঠামোগত সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও তার সঙ্গে মানবসম্পদের দক্ষতাও বাড়াতে হবে। এটা অত্যন্ত প্রয়োজন। আরেকটি বিষয় হলো জবাবদিহিতা। বরাদ্দ দেয়া হলো। বছর শেষে বাস্তবায়ন হলো না। কেন হলো না, এ জবাবদিহিতাটা নেই। বাজেটের যদি একটা মিডটার্ম কারেকশনের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে বাস্তবায়নের কী হলো না হলো, সেটি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করা যায়। সংসদেও আলোচনা করা উচিত। আমাদের এখানে এ চর্চা নেই। আমাদের বাজেটে সাধারণত ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা হয়। কিন্তু করোনাকালে সরকারি ব্যয় বাড়াতে গিয়ে বাজেট ঘাটতি যদি বাড়ে, তাহলেও সমস্যা নেই। চলতি অর্থবছরে এটাকে বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। যেভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তাতে তার কাছে যাবে না। অথচ প্রয়োজন হলে ৭, ৮ শতাংশ ঘাটতি হতে পারে। সামগ্রিকভাবে, একদিকে তাত্ক্ষণিক কার্যক্রম ও অন্যদিকে মধ্যমেয়াদি সংস্কার, দক্ষতা বৃদ্ধি এগুলো ভীষণ প্রয়োজন।

নগদ সহায়তা কর্মসূচি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা গেলে আমাদের ভোগ ও উৎপাদনে কি গতিশীলতা আসত না?

হ্যাঁ, অবশ্যই ভোগ ও উৎপাদনে গতিশীলতা আসত। একটা হলো দরিদ্র জনগোষ্ঠী, নিম্ন আয়ের মানুষকে সরাসরি নগদ অর্থ দিতে হবে। আমাদের গবেষণা ও অন্যদের গবেষণায় উঠে এসেছে যে প্রণোদনা ঘোষণার পরও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কাছে অর্থ পৌঁছেনি। অনেকেই ব্যাংকিং ব্যবস্থার অতি আনুষ্ঠানিকতার কারণে ঋণ নিতে পারেননি। অনেকেই আবার ইচ্ছা করেও নেননি। কারণ তারা ভাবছেন যে এমনিতে ব্যবসার অবস্থা খারাপ, তার মধ্যে ঋণ নিলে কীভাবে ফেরত দেবেন। ঋণের বোঝা তারা নিতে চাননি। যে কারণে অনেকেই বলেছেন, ঋণের পরিবর্তে তাদের যদি এককালীন সরাসরি অর্থ দেয়া হতো, বিভিন্ন ফি যদি মওকুফ করা হতো, তারপর তাদের ব্যবসার ভাড়া, উপযোগ বিল যদি দেয়া হতো, তাহলে কিন্তু অনেক উপকার হতো। সে কারণে তারা ওই ধরনের সাপোর্ট  চেয়েছে। সবার জন্য নয়। বড় ব্যবসায়ীদের তেমন সমস্যা হয়নি। তারা চাপের মুখে আছে। কিন্তু প্রণোদনার অর্থ তারা নিতে পারছেন বা ব্যবহার করতে পারছেন। কিন্তু যারা অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, তাদের জন্য এককালীন সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে।

তার জন্য আবার কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নগদ সহায়তার ক্ষেত্রে বরাদ্দটা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম হয়েছে। আবার যারা পেয়েছে, তাদের সবার যে প্রয়োজন ছিল তাও নয়। বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা গেছে, অনেক সময় যাদের প্রয়োজন নেই, তারা হয়তো পেয়েছেন কিন্তু যাদের প্রয়োজন তারা পাননি। এখানে সুবিধাভোগীর তালিকাটা স্বচ্ছভাবে প্রস্তুত করাটা প্রয়োজন ছিল। আরেকটি বিষয়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাভোগীর তালিকাটা গ্রামকেন্দ্রিক। এখানে নগর দরিদ্র জনগোষ্ঠী নেই। সুতরাং তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে স্বচ্ছভাবে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অংশগ্রহণমূলকভাবে এ তালিকা প্রণয়ন করতে হবে, যারা বাদ যাবে তারা যাতে নিজেরা আবেদন করে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বচ্ছতা আনতে হবে।

সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের উন্নতির পেছনে বেসরকারি সংস্থাগুলোর বড় ভূমিকা থাকলেও করোনা সংকটে সরকার তাদের সম্পৃক্ত করছে না কেন?

দেশে অতীতে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দেখেছি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, সাধারণ জনগণ, কমিউনিটি সবাই একত্র হয়েই কিন্তু মোকাবেলা করেছে। কিন্তু করোনার এ সময় আমরা সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে এক ধরনের অনীহা  দেখেছি। যারা গ্রামগঞ্জে ও প্রত্যন্ত এলাকায় কাজ করে এবং যাদের একটা বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে, এবার তাদের সম্পৃক্ত করার কোনো আগ্রহ দেখছি না। এ কারণে যতটা তাড়াতাড়ি ও দক্ষতার সঙ্গে সংকট মোকাবেলা করতে পারতাম, তা কিন্তু হচ্ছে না। অতীত অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগাতে পারলে আরো ভালো ফল পাওয়া যেত। সেটি এখন দুঃখজনকভাবে দেখছি না।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, করোনাকালে আশানুরূপভাবে রাজস্ব আহরণ করা যায়নি। রাজস্ব আহরণ কীভাবে বাড়ানো যেতে পারে?

খুবই দুঃখজনক যে একদিকে সরকারি ব্যয় বাড়েনি, অন্যদিকে উন্নয়ন খাতের ব্যয়টা আরো কমেছে। দেখা যায় প্রশাসনিক ও পরিচালন ব্যয়েই অনেক অর্থ চলে যায়। এডিপি বাস্তবায়ন এত খারাপ আমাদের দুর্বলতার প্রতিফলন। অথচ করোনার সময়ে এটি আরো বেশি হওয়ার দরকার ছিল। আমরা বলেছি ব্যয় বাড়াতে হবে। কিন্তু সম্পদের অপচয় যেন না হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে কোথায় ব্যয় করব, কীভাবে ব্যয় করব, তাও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরামর্শ ছিল, যেসব প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারব, কেবল সেখানেই ব্যয় করতে হবে। উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক  দেশেই সরকারের প্রশাসনিক ব্যয়ে কাটছাঁট করা হয়েছে। আমাদের এখানেও কমানো সম্ভব। সেখানে কমাতে পারলে ওই অর্থ করোনা মোকাবেলায় কাজে লাগানো যেত। এখনো সময় আছে, সদিচ্ছা থাকলে সেটি করা সম্ভব। আরেকটি বিষয় হলো, করোনার সময়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ভালো অংকের তহবিল এসেছে। সেটি আরো কীভাবে বাড়ানো যায়, তার চেষ্টা করতে হবে।  যে অর্থগুলো আসছে তা দ্রুত ছাড় করে ভালোভাবে ব্যবহার করতে হবে। বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহার করার ক্ষেত্রে চিরাচরিতভাবে যে ধীরগতি থাকে, পাইপলাইনে অনেক সাহায্য রয়ে যায়, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যও কিন্তু দক্ষতা লাগে। সেই দক্ষতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে আরো কীভাবে সহায়তা আনা যায়, তার জন্য তত্পর থাকা উচিত। আরেকটি বিষয়, ব্যক্তি খাতে অনেক দিন ধরে বিনিয়োগ স্থবির। করোনাকালে অবস্থা আরো খারাপ। সেক্ষেত্রে ব্যাংকে পড়ে থাকা অলস তারল্য থেকে ঋণ দিয়ে ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। আমরা দেখছি, সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ব্যয় সংকুলান করছে। ফলে সুদ পরিশোধ বাবদ বিপুল অর্থ খরচ হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য থেকে ঋণ নিলে এ ধরনের ব্যয় কমে আসবে। সুতরাং বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ব্যয় পরিকল্পনা করলে অনেক জায়গা থেকে অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব। আমাদের কর জিডিপি অনুপাত খুবই কম। কভিডকালে তা আরো নিম্নমুখী হয়েছে। কর আদায় কম হয়েছে। তার কারণে কমেছে। এক্ষেত্রে রাতারাতি উন্নতি সম্ভব নয়। মধ্যমেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও প্রযুক্তির ব্যবহার প্রয়োজন। বিদ্যমান উৎস থেকেই আমরা অর্থ সঞ্চালন বাড়াতে পারি এবং তা ব্যবহার করতে পারি। তারপর দেখা যাবে আমাদের আর কী প্রয়োজন হবে। মনিটারি পলিসির মাধ্যমেও অর্থের জোগান করা যাবে, প্রয়োজন হলে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারী একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকট। সেই অনুযায়ী সরকারের পদক্ষেপ ও প্রতিক্রিয়া ঠিক আছে কী?

সরকার ভেবেছিল গত বছরই করোনা থেকে মুক্তি পেয়ে  যাবে। এ বছরও ভাবছে তারা এখান থেকে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। আসলে কিন্তু এখনো মুক্তি মিলছে না। গণহারে টিকা দেয়া হলে অনেকটা স্বস্তিকর অবস্থায় আমরা যেতে পারব। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক টিকা প্রদানের কারণে তারা সবকিছু খুলে দিচ্ছে। মাস্ক পরাও কমিয়ে দিচ্ছে। আমরা তো সেটি করতে পারেনি। আমাদের এখনো টিকাপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। আগামী এক বছরে আমাদের দেশের ৮০-৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে দেয়া সম্ভব হবে কিনা, আমরা জানি না। সুতরাং টিকা ছাড়া করোনা আমাদের দেশ থেকে যাবে না। করোনার নানান ধরনের আমরা খোঁজ পাচ্ছি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, চেহারা পাল্টে এটা নানাভাবে থাকবে। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, কোনো না কোনোভাবে আগামী কয়েক বছর ধরে এটা থেকে যেতে পারে। সুতরাং করোনাসংক্রান্ত স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ আমাদের অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে। সবকিছু আগের মতো হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা আমি এখনো দেখছি না।

করোনায় কর্মচ্যুতির কারণে বেকারত্ব সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। বেকার সমস্যা সমাধানে সরকারের পরিকল্পনা দেখছেন কি?

শিক্ষা নিয়ে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আসলে দেখছি না। এ নিয়ে চিন্তাভাবনা আছে বলে প্রতিভাত হচ্ছে না।  গত প্রায় দেড় বছরে তো আমরা তা দেখিনি। শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে দেড় বছর নষ্ট হয়ে গেছে। আরো কত মাস নষ্ট হবে, জানি না। এর মূল্য আগামী অনেক বছর চুকাতে হবে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বড় অংশই ঝরে পড়বে। তারা আর শিক্ষায় ফিরতে পারবে না। সুতরাং শিক্ষা অর্জন করে শ্রমবাজারে গিয়ে আয় করল, প্রজন্মগতভাবে আরো উন্নত জীবন মান গড়ল, অনেকের জন্য সেটি আর সম্ভব হবে না। আবার এর মধ্যে তাদের অনেকের চাকরির বয়স চলে যাবে। এরপর যে ছাত্রছাত্রীরা আসবে, তারাও এদের সমপর্যায়ের হয়ে যাবে। এতে শ্রমবাজারে প্রবেশের সংখ্যা ও প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে যাবে। এটা একটা দিক। আরেকটি দিক হলো, তারা একটি বিস্তৃত সামাজিক ও পেশাগত  নেটওয়ার্ক হারাবে, যা তাদের কর্মজীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে নানাভাবে সাহায্য করে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ঘরে বসে থাকায় তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কাজেই এটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। এখন এটি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা হয়েছে। যারা শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করেন তারা সুনির্দিষ্ট অনেক সুপারিশ দিয়েছেন। স্কুলগুলো অবিলম্বে খুলে দেয়ার পরিবেশ তৈরি করা, স্কুলে ১২-১৩টি বিষয়ের পরিবর্তে আপাতত গণিত, ইংরেজি, বাংলা ও বিজ্ঞানের মতো  মৌলিক বিষয়গুলো পড়ানো প্রভৃতি সুপারিশের কথা তারা বলেছেন। এসব সুপারিশ যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে আনতে পারব।

করোনাসৃষ্ট অভিঘাত থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আসন্ন বাজেটে সুনির্দিষ্টভাবে কোন দিকগুলোয় নজর দেয়া দরকার বলে মনে করেন?

ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে। এক. সরকারি ব্যয় বাড়ানো এবং প্রত্যক্ষ সহায়তা বাড়ানো। দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ পৌঁছে দিতে হবে। একই সঙ্গে খাদ্যসহায়তা বাড়ানো। দুই. স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাগুলো দূর করা। বিশেষ করে করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে টিকা কার্যক্রম জোরদার করা। আমাদের লক্ষ্য থাকতে হবে আমরা যেন পুরো জনগোষ্ঠীকে টিকা দিয়ে দিতে পারি। তিন. সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতা বাড়ানো। এক্ষেত্রে বরাদ্দ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি সুদক্ষভাবে এর পরিচালনা নিশ্চিত করাও জরুরি। যাতে সঠিক লোকের কাছে সাহায্য পৌঁছে। চার. স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাব্যবস্থা পুনরায় সচল করা। পাঁচ. কর্মসংস্থান বাড়ানো। কর্মসংস্থান বাড়াতে সরকারকে একদিকে বড় বড় প্রকল্পে ব্যয় করতে হবে, অন্যদিকে উদ্যোক্তার কাছে প্রণোদনার অর্থ পৌঁছে দিতে হবে। বেকার তরুণরা যাতে স্ব-উদ্যোগে ছোট ছোট ব্যবসায় যুক্ত হতে পারেন, তার  জন্য অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে। ছয়. প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও দক্ষতা বাড়ানো। কারণ করোনা একটি বিষয় পরিষ্কার করেছে যে প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক কিছু করা সম্ভব। করোনা চলে যাওয়ার পরও অনেক কিছু প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। এজন্য প্রযুক্তি খাতে বাজেটে কর রেয়াত দিতে হবে।