অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে – ড. মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in খবরের কাগজ on 22 January 2025

ড. মোস্তাফিজুর রহমান একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মাননীয় ফেলো। তিনি সিপিডির নির্বাহী পরিচালক (২০০৭-১৭) এবং তারও আগে সিপিডির গবেষণা পরিচালক (১৯৯৮-০৭) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে শিক্ষক হিসেবে ২৫ বছর অধ্যাপনার পর ২০১২ সালে সিপিডিতে পূর্ণকালীন দায়িত্ব পালনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। রাজস্ব, আর্থিক নীতি এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাণিজ্যনীতি এবং বাণিজ্য সংস্কার, বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থা এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোর স্বার্থ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক শেহনাজ পূর্ণা

যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল অনুঘটক হলো বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি হয় না। আর দ্বিতীয় কথা হলো, আমি কত ইউনিট বিনিয়োগ করে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ করতে পারি। আমি যদি রেশিও কমাতে পারি, তার মানে হলো- আমার উৎপাদনশীলতা ভালো। আমি যদি ৪ ইউনিট দিয়ে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথের পরিবর্তে ৩ ইউনিট বিনিয়োগ করে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ করতে পারি, এটাই উৎপাদনশীলতা। এই উৎপাদনশীলতাটুকু জরুরি। আমাদের দেশে যেটা দেখছি, ২৪-২৫ শতাংশের মধ্যে বিনিয়োগ থমকে আছে কয়েক বছর। ক্রেডিট যা নেওয়া হয় ব্যাংক থেকে বিনিয়োগের জন্য, এখানেও স্থবিরতা দেখছি। আমরা দেখছি যে, আমদানি ক্রেডিটের মেশিনারি করে আমদানির মাধ্যমে যন্ত্রপাতি এনে যে বিনিয়োগ করা হয়, সেই আমদানি নিয়েও একটা স্থবিরতা আছে। সবটা মিলিয়ে বিনিয়োগে একটা বড় ধরনের স্থবিরতা আছে। এর সঙ্গে কর্মসংস্থান, শোভন কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির চাপকে সামাল দেওয়া- অনেক কিছু জড়িত। সুতরাং আমাদের অবশ্যই বিনিয়োগে চাঞ্চল্য আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল গত কয়েক মাসে। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল- ঘটনা কোন দিকে যায়। এখন নিশ্চয়তা বা স্বস্তির একটা সময় এসেছে। কাজেই আশা করব যে, বিনিয়োগকারীরা সে সুযোগটা নেবেন। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরাও আসবেন। দুটি ভালো পদক্ষেপ হয়েছে; সেটা হলো- আমাদের রিজার্ভের ওপর চাপ কিছুটা কমেছে। এলসি খোলার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ছিল, এগুলো ক্রমান্বয়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে।…

খবরের কাগজ: কর-জিডিপি অনুপাতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে নিচে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন?

ড. মোস্তাফিজুর রহমান: কর-জিডিপির অনুপাতে উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে কেবল শ্রীলঙ্কাই আমাদের কাছাকাছি আছে। অর্থাৎ প্রতিবেশী দেশগুলোর কর-জিডিপির অনুপাত আমাদের দ্বিগুণের মতো। এটার ফলে বাংলাদেশ একটা বিপজ্জনক এবং বাধ্যতামূলক ঋণনির্ভরতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। যেটা থেকে আবার ঋণ পরিষেবার একটা বড় চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। সুতরাং অবশ্যই আমাদের কর-জিডিপির হার বাড়াতে হবে।

সেখানে বর্তমান সরকার সংস্কার কমিটি করেছে। সেই সংস্কার কমিশন কাজ করেছে। তারা বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিচ্ছে। আমার মনে হয় যে, একটা হতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয়ত হতে হবে প্রযুক্তির বাস্তবায়ন। প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এখন যে সিস্টেম আছে, এটাতে বড় ধরনের পরিবর্তন করতে হবে। এনবিআরের নিজস্ব যে জনশক্তি আছে, তা দিয়েই কাজ পরিচালনা করতে হবে। এনবিআরের নীতিমালা প্রণয়ন এবং নীতিমালা বাস্তবায়ন দুই ভাগে ভাগ করতে হবে। এনবিআরে যারা কাজ করেন তাদের ওপরের দিকে ওঠার রাস্তা যাতে রাখা হয়, এমন ধরনের সংস্কার করতে হবে। এটার একটা দিক আছে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। প্রযুক্তিকে যত বেশি কাজে লাগানো যাবে তত বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব হবে। আমরা ইতিবাচক একটা দিক দেখলাম যে, এবার ই-সাবমিশন বা ইলেকট্রনিক সাবমিশন অনেক ভালো হয়েছে। করপোরেটের ক্ষেত্রে, ব্যক্তি খাতের ক্ষেত্রে এগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। ডিজিটাল প্রস্তুতিটা রাখতে হবে। আমাদের কাস্টমস, ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স- এগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় করতে হবে। যে সফটওয়্যারগুলো তারা ব্যবহার করেন সে ক্ষেত্রে ইন্টার অপারেবিলিটি থাকে। একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ একই সঙ্গে সমন্বয় থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে থাকে- যাতে ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেম আমরা করতে পারি। আমাদের প্রত্যক্ষ কর মাত্র ৩২-৩৩ শতাংশ। এটাকে আরও কীভাবে বাড়ানো যায় তা ভাবতে হবে। সেটা করতে গেলে ইন্টার-অপারেবিলিটি অব দ্য সিস্টেমস অর্থাৎ কাস্টমস, ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স- এগুলোর সমন্বয় করতে হবে। বেশি বেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইনকাম ট্যাক্সের কাজকে কেন্দ্রীয়ভাবে করতে হবে। এটা বিভিন্ন দেশে আছে।

ভারতে যে রকম আধার কার্ড প্রচলন করা হয়েছে, ইচ্ছা করলে আমরা সে রকম পারসোনাল অ্যাকাউন্ট নম্বর বা যেটা আমরা টিন বলি সেটার মাধ্যমে ইনফরমেশন দিতে পারবে। আধারের ইউনিক নম্বর দিয়ে তারা বড় ধরনের সব খরচের হিসাব করতে পারবে। তাহলে যিনি ইনকাম ট্যাক্সের বিষয়গুলো দেখেন, তিনি তখন সমন্বয় করতে পারবেন। একটা মানুষ কী রকম ব্যয় করছেন আর তিনি আয় করে কত দেখাচ্ছেন সেটা জানা যাবে। বিভিন্ন দেশে এগুলোর বেস্ট প্র্যাকটিস বা ব্যবহার আছে। এগুলো গ্রহণ করতে হবে। আমার মনে হয় যে, ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর বিশাল সুযোগ আমাদের আছে। সাধারণ জনগণের ওপর অপ্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে নয়, প্রত্যক্ষ কর কীভাবে আমরা বাড়াতে পারি সেই চিন্তা করতে হবে। যাদের কর দেওয়ার শক্তি আছে, কিন্তু দেন না, যাদের বিভিন্ন সময় শুল্ককর ১০ শতাংশ দিলেই সব সাদা করা যাবে, রিয়েল এস্টেট, বিনিয়োগ করলে সাদা করা যাবে- এ ধরনের যারা আছেন, তাদের প্রণোদনা দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি। তা থেকে সরে এসে ডিজিটালাইজেশনে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং এনবিআরের মধ্যে জবাবদিহি এবং প্রণোদনা দুটির সমন্বয় করে আমাদের এগুলো মোকাবিলা করতে হবে। কারণ দেখা যাচ্ছে যে, রাজস্ব যা আহরণ করি, রাজস্ব ব্যয়ে তা চলে যায়। পুরো উন্নয়ন ব্যয়টা হয়ে গেছে ঋণনির্ভর। হয় অভ্যন্তরীণ, নয় বৈদেশিক। এটা টেকসই হবে না। যার ফলে বিনিয়োগ পরিষেবার ভার ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। আমরা যদি রাজস্ব আদায় বাড়াতে পারি, তাহলে উদ্বৃত্ত রাজস্ব দিয়েও উন্নয়ন ব্যয়ের একটা অংশ মেটাতে পারব। ঋণনির্ভরতা এবং সুদাসলের কারণে বড় ধরনের একটা অঙ্ক আমাদের বাজেটে রাখতে হচ্ছে; যা রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এটা টেকসই হয় না এবং এটা থেকে আমাদের ফিরে আসতে হবে।

খবরের কাগজ: বেসরকারি বিনিয়োগ অনেক বছর ধরে একই জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার কী পদক্ষেপ নিতে পারে?

ড. মোস্তাফিজুর রহমান: যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল অনুঘটক হলো বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি হয় না। আর দ্বিতীয় কথা হলো, আমি কত ইউনিট বিনিয়োগ করে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ করতে পারি। আমি যদি রেশিও কমাতে পারি, তার মানে হলো- আমার উৎপাদনশীলতা ভালো। আমি যদি ৪ ইউনিট দিয়ে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথের পরিবর্তে ৩ ইউনিট বিনিয়োগ করে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ করতে পারি, এটাই উৎপাদনশীলতা। এই উৎপাদনশীলতাটুকু জরুরি। আমাদের দেশে যেটা দেখছি, ২৪-২৫ শতাংশের মধ্যে বিনিয়োগ থমকে আছে কয়েক বছর। ক্রেডিট নেওয়া হয় ব্যাংক থেকে বিনিয়োগের জন্য, এখানেও স্থবিরতা দেখছি। আমরা দেখছি যে, আমদানি ক্রেডিটের মেশিনারি আমদানির মাধ্যমে যন্ত্রপাতি এনে যে বিনিয়োগ করা হয়, সেই আমদানি নিয়েও একটা স্থবিরতা আছে। সবটা মিলিয়ে বিনিয়োগে একটা বড় ধরনের স্থবিরতা আছে। এর সঙ্গে কর্মসংস্থান, শোভন কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির চাপকে সামাল দেওয়া- অনেক কিছু জড়িত। সুতরাং আমাদের অবশ্যই বিনিয়োগে চাঞ্চল্য আনতে হবে।

এক ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল গত কয়েক মাসে। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল- ঘটনা কোন দিকে যায়। এখন নিশ্চয়তা বা স্বস্তির একটা সময় এসেছে। কাজেই আশা করব যে, বিনিয়োগকারীরা সে সুযোগটা নেবেন। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরাও আসবেন। দুটি ভালো পদক্ষেপ হয়েছে; সেটা হলো- আমাদের রিজার্ভের ওপর চাপ কিছুটা কমেছে। এলসি খোলার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ছিল, এগুলো ক্রমান্বয়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে। ক্যাপিট্যাল মেশিনারিজের আমদানি, বিভিন্ন ইন্টারমিডিয়েট ইনপুটের আমদানি- এগুলোর মধ্যে কিছুটা চাঞ্চল্য আমরা দেখছি। সেটার একটা প্রতিফলন ১৩ শতাংশ ইন্টারেস্ট রপ্তানি বৃদ্ধির মধ্যে আমরা দেখেছি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাজার। নতুন বিনিয়োগ করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তার পর সেই টাকা খরচ করার ক্ষেত্রে এখনো প্রতিবন্ধকতা আছে। ১৫-১৬ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে একজন ব্যবসায়ী কত মুনাফা করতে পারবেন। যেটা দিয়ে তিনি বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন! সুতরাং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসছে। দ্বিতীয় হচ্ছে, অনেক জায়গায় আমরা স্পেশালি ইকোনমিক জোন করেছিলাম। যেখানে বিনিয়োগকারীদের নিষ্কণ্টক জমি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটার সঙ্গে আমাদের অন্য সার্ভিসগুলো দিতে হবে।

আমরা একটা ওয়ানস্টপ সার্ভিস করেছি ২০১৮ সালে। সেটা আমরা এখনো কার্যকর করতে পারিনি। এগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে। ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করতে হলে আমাদের বিদ্যুৎ, গ্যাস দিতে হবে। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো করতে হবে। এসব জায়গায় আমাদের বড় ধরনের একটা দুর্বলতা রয়েছে। এটাকে মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমান সরকার ১০০টা প্ল্যানের জায়গা থেকে সরে এসে ১০টা স্পেশাল জোনকে ভালোভাবে চালু করতে চাচ্ছে। আমরা কিন্তু আগেই বলেছিলাম, ১০০টা স্পেশাল জোন করার জন্য জমি অধিগ্রহণ না করে ১০ থেকে ১২টা করে ভালোভাবে চালান। বর্তমান সরকার এ পদক্ষেপগুলোই এখন নিচ্ছে। আমার মনে হয় এটা খুব ভালো যে, তারা এটা করতে চাচ্ছে। এটা হলে বিনিয়োগে চাঙাভাব আসবে। আর যারা বৈদেশিক বিনিয়োকারী, যারা আমাদের দেশে ২ বিলিয়ন ডলারের মতো নেট এসডিআই নিয়ে আসে, ভিয়েতনামে যেখানে ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার, কম্বোডিয়া কত ছোট একটা দেশ- সেখানেও বৈদেশিক বিনিয়োগ অনেক বেশি। বৈদেশিক বিনিয়োগ যদি বাড়ানো যায় তাহলে রপ্তানি বাজারে একটা ভালো সংযোগ থাকে। আমাদের রপ্তানিও বাড়ে। আমরা ৫০ বিলিয়ন ডলারের মতো রপ্তানি করি।

ভিয়েতনামের অর্থনীতি সাইজে আমাদের থেকে ছোট। তারা ৩৮০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে গত বছর। সুতরাং যারা আমদানি করবে, রপ্তানি করবে এবং স্পেশাল জোনগুলো ব্যবহার করবে, তাদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিসের ক্ষেত্রে গ্যাস, বিদ্যুৎ, সেন্ট্রাল প্ল্যান, দক্ষ জনশক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করতে হবে। শুধু জোন করলেই হবে না। আরও অনেক সমান্তরাল কাজ আমাদের করতে হবে। সেসব জায়গায় এখনো অনেক দুর্বলতা আছে। যা এখন উদ্যোগ-উদ্যম নিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক একটা পুনর্গঠন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার বিভিন্ন ধরনের পলিসিগত পরিবর্তনও আনার চেষ্টা চলছে এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টাও চলছে। বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি হবে না, কর্মসংস্থান হবে না, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, জীবনমান উন্নত হবে না। সেই বিনিয়োগ মূলত ব্যক্তি খাতেই করতে হবে। আমাদের দেশে ব্যক্তি খাত ৪ টাকা বিনিয়োগ করলে, সরকার বিনিয়োগ করে ১ টাকা। ব্যক্তি খাত সরকারি বিনিয়োগকে চাঙা করতে পারে। সুতরাং সরকারি খাতের বিনিয়োগ ও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের মধ্যে এটা সমান্তরাল সমন্বয় দরকার আছে। যাতে করে ব্যক্তি খাত সরকারি বিনিয়োগের সুবিধা নিয়ে ব্যবসা করতে পারে।

খবরের কাগজ: আমাদের দেশে তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি করতে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি?

ড. মোস্তাফিজুর রহমান: নতুন উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে আমি বলব যে, দেশের অর্থনীতিতে শতকরা প্রায় ৫৬ ভাগ হলো সার্ভিসেস সেক্টর। কৃষি ১২ শতাংশ, বাকি যেটুকু থাকে ওইটুকু হলো আমাদের শিল্প খাত, অর্থাৎ ৩২ শতাংশ। তার মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং আরও কম। সার্ভিসেস সেক্টরে নতুন অনেক ধরনের কর্মকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আমি বলব- শুধু শিল্পোদ্যোক্তা নয়, সার্ভিসেস সেক্টর, ই-সার্ভিস, আইটি অ্যানাবল সার্ভিসেও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। যারা আসতে চাচ্ছেন তাদের জন্য দেশের শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্য আমাদের ইনসেনটিভ আছে। সেবা খাতে যে উদ্যোক্তা ইয়াং জেনারেশন, তাদের জন্য স্পেশাল উইনডো সৃষ্টি করা দরকার। এগুলোতে আরও উদ্যোগ-উদ্যম নিয়ে কাজ করতে হবে। ইন্টারনেটের স্পিড বাড়ানো, তার খরচ কমানো- আইটি অ্যানাবল সার্ভিসে যারা আসে তাদের জন্য এ সুযোগগুলো অবারিত করতে হবে। নতুন নতুন খাতে সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দেশে ই-কমার্স এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিশেষত কোভিডের পর থেকে এই জায়গাগুলোতে নতুন উদ্যোক্তারা আসছেন। শিল্পোদ্যোক্তা ও সেবা খাতের উদ্যোক্তা- দুটির দিকে নজর দিতে হবে। যাতে করে কর্মসংস্থান বাড়ে, আবার রপ্তানিও আমরা করতে পারি। সুতরাং একটা সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। বিশেষত, সেবা খাতে উদ্যোক্তাদের কীভাবে আমরা সহায়তা করতে পারি। আমরা জানি যে, ইন্ডিয়ায় আইটি অ্যানাবল সার্ভিসের এক্সপোর্টই হলো ১৬০ থেকে ১৭০ বিলিয়ন ডলার। আমার জানা মতে, ১৯৯৯-২০০০ সালে এটা ৫ বিলিয়ন ডলারও ছিল না। এটাকে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। উদ্যোক্তারা যাতে ওয়ানস্টপ সার্ভিসের সুবিধাটা পেতে পারেন, অবকাঠামোর সুবিধা পেতে পারেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সুবিধা পেতে পারেন, আমদানি স্তরে যাতে হয়রানির সম্মুখীন না হন, পোর্টের টান অ্যারাউন্ড টাইম যাতে আমরা কমাতে পারি। আমাদের অনেক বাণিজ্যে, বিশেষ করে ভারত আমাদের বড় ট্রেড পার্টনার। আমরা যদি আমদানি খরচ কমাতে পারি তাহলে এটা ভোক্তা, উদ্যোক্তা, রপ্তানিমুখী শিল্প; যারা আমদানির ওপর নির্ভর করে, তাদের জন্য ইতিবাচক। সুতরাং সেসব জায়গায়ও আমাদের ট্রেড ফেইজ সিলেকশন, বাণিজ্য সহজীকরণের যেসব উদ্যোগ পেপারলেস ট্রেড, সিঙ্গেল উইনডো- এসব জায়গায় নজর দিতে হবে। কারণ ল্যান্ড পোর্টের মাধ্যমে আমাদের এই আঞ্চলিক বাজারে প্রবেশ এবং এটা আমাদের উদ্যোক্তাদের খরচ অনেক কমায়। এই পলিসি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সেটার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন রকম সহায়তা করতে হবে। কৃষি খাতে আমরা বাইরে যেতে পারছি না। অ্যাগ্রোবেস্ট ইন্ডাস্ট্রিজ সেখানেও দরকার। আমাদের এসপিএস, ইবিটি- এ ধরনের স্ট্রানভার যা আছে সেগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কুল চেইন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন আছে। এগুলো সামনের দিকে আরও বাড়বে। গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট প্রতিযোগিতার যে পরিবেশ, সেই পরিবেশও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। সুতরাং সেটার সঙ্গে তারা যাতে সামঞ্জস্য বিধান করেও উৎপাদন, রপ্তানি করতে পারেন, তাদের সেই সহযোগিতা করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তিত বাণিজ্য পরিস্থিতি, বিশ্বায়ন পরিস্থিতি- এটাতে তারা শক্তিশালী অবস্থান থেকে যাতে সেখানে ঢুকতে পারেন, সে জন্য তাদের প্রয়োজনমাফিক সহায়তা দিতে হবে। আমাদের যে প্রণোদনা কাঠামো আছে, তার পরিবর্তন লাগবে। রেডিমেট গার্মেন্টসের ভেতরেও অনেক সম্ভাবনা আছে। মেইনমেইড ফাইবারের এখন গ্লোবাল মার্কেট ৭৫ শতাংশ আর আমাদের এখানে মেইনমেইড হলো ২৫ শতাংশ। কটন বেইজড ৭৫ শতাংশ। তার পর আছে আরএমজি বৈচিত্র্যকরণ। আরএমজির বাইরে যারা আসতে চাচ্ছেন, যেমন- সিনথেটিক, লেদার, ফুডওয়্যার, লাইটিং ইঞ্জিনিয়ারিং, আমাদের ফার্মাসিটিক্যালস, আসবাবপত্র ইত্যাদি।

আমি মনে করি যে, শ্রমঘন যে প্লান্ট আছে- এসব জায়গায় আমাদের বড় ধরনের একটা সুযোগ আছে। এগুলোকে আইডেনটিফাই করে আমরা যদি বিশেষ করে ইকোনমি জোনগুলো, বিশেষ করে নিষ্কণ্টক জমির অভাব বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। সেটার সঙ্গে সমন্বয় করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, দক্ষ শ্রমিক তৈরি ভালোভাবে করতে পারলে স্থানীয় বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে বাংলাদেশও ভিয়েতনামের মতো বড় রপ্তানিকারক দেশ হতে পারবে। রপ্তানির ভেতরে টেকনোলজিক্যাল যে কম্পোনেন্ট, আমাদের দেশে উচ্চ টেকনোলজি কম্পোনেন্ট ১ শতাংশেরও কম আর ভিয়েতনামে ৪৩ শতাংশের বেশি। সেই রকম একটা টেকনোলজিক্যাল রেডিয়েশন করে আমাদের কিন্তু তুলনামূলক যে সুবিধাগুলো আছে, তাকে প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় রূপান্তরিত করার একটা সুযোগ আছে। আগামীতে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হচ্ছে, তখন অনেক রেফারেন্স সুবিধা, বাজারসুবিধা, শুল্কমুক্ত সুবিধা, কোটামুক্ত সুবিধা চলে যাবে। সেখানেও আমাদের উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে হবে। যাতে করে এই বাজার সুবিধানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থেকে তারা দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় উত্তীর্ণ হতে পারে। যার মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বল্পোন্নত দেশের গ্র্যাজুয়েশন, যেটা ২৪ নভেম্বর ২০২৬-এ হবে, তা টেকসইও মসৃণভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি।

খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।