Originally posted in খবরের কাগজ on 11 December 2023
বর্তমানে অর্থনীতিতে নানামুখী চ্যালেঞ্জ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে করোনা-পরবর্তী সময়ে নতুন করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব ২০২২-২৩ অর্থবছর এবং এই অব্যাহত পরিস্থিতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ ছয় মাসেও আমরা দেখতে পাচ্ছি। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতি একধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে অর্থনীতিতে একধরনের শ্লথ গতির প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে- যা উৎপাদন, বিনিয়োগ, রপ্তানি ও আমদানির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে উচ্চমূল্য, দুর্বল বিনিময় হার, ডলারের বিপরীতে টাকার অব্যাহত মূল্যহ্রাস, এমনকি সুদের হারের ক্ষেত্রেও এ পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও এর একটি প্রভাব পড়ছে। ফলে সরকারের বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ১১ বছরে এডিপি বাস্তবায়ন সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণে সরকারি উৎসগুলো থেকে অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রেও একধরনের ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণ এবং দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করা ও প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। ঘাটতি অর্থায়নের জন্য সরকার যে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ গ্রহণ করে সেখানেও একধরনের নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অর্থনীতির সব পরিস্থিতিতেই নানা ধরনের দুর্বলতা দেখা দিচ্ছে।
দেশে বৈদেশিক ঋণের যে ঘাটতি সেটিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যে পরিমাণ রিজার্ভ ছিল তাও কমে গেছে। অন্যদিকে রিজার্ভের পরিমাণ তুলনামূলক বৃদ্ধি না হওয়ায় আগের ৪৮ বিলিয়ন ডলার কমে এখন ২৪ বিলিয়নে পৌঁছেছে। ব্যবহারযোগ্য ডলারের পরিমাণ মাত্র ১৯ বিলিয়ন। ফলে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই একধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এর বিপরীতে যেমন টাকা অবমূল্যায়িত হয়েছে, অন্যদিকে টাকার বিপরীতে আমদানিতে ঘাটতির কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমদানিনির্ভর কাঁচা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতিতে এর এক প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি। এ ধরনের শ্লথ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচনী সময়ে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা দেখা যায়। আবার নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প দ্রুত শেষ করা, মুদ্রাস্ফীতিজনিত মুদ্রা সরবরাহ, কোনো কোনো সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
মূল্যস্ফীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাজার ব্যবস্থাপনা ও তদারকিতে দুর্বলতা, বেসরকারি খাতে অব্যাহতভাবে অতি নির্ভরশীলতা এবং দেশের ভেতরে যারা বড় ব্যবসায়ী তাদের বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর প্রভাব বিস্তার। পণ্য সরবরাহে তাদের একধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাও মূল্যস্ফীতির বড় কারণ। অব্যাহত মূল্যস্ফীতিতে প্রকৃত আয় যেমন কমেছে, একই সঙ্গে তার খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অনেক ছাড় দিতে হয়েছে। বিশেষত, সীমিত অথবা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যে সঞ্চয় সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষ দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য রাখে, সেটা তাকে ভাঙতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকে যে পরিমাণ সঞ্চয় থাকে সেগুলো ক্রমাগত কমছে। নির্বাচনের সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা সব সময়ই আমরা দেখে এসেছি। এ বছরও আমরা সেই অস্থিরতা দেখছি। মোটামুটিভাবে আমরা সব সময় দেখে এসেছি ব্যবসায়ীরা এই সময়কে উপলক্ষ করে বিনিয়োগ কমিয়ে দেন। দেশের বাইরে থেকে যারা পণ্য আমদানি করেন, তারাও এ সময়ে পণ্য আমদানিতে সাবধান থাকেন। নির্বাচন-পরবর্তীকালীন এ ধরনের অস্থিরতা কেটে যাবে, তা মনে হয় না। অন্যান্য সময় অর্থনীতির ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা কেটে গেলেও এবার তা প্রলম্বিত হতে পারে।
বিভিন্ন সহযোগী দেশ যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক জড়িত, তাদের সঙ্গে নির্বাচনকেন্দ্রিক অবস্থানের কারণে যদি সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, সেটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না। এসব বিষয়ে বিশ্লেষণ করলে আমাদের সামনের সময়গুলো অর্থনীতির জন্য খুব একটা মসৃণ হবে না। আগামীর সময়গুলো আমাদের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে পার করতে হবে। ছয় মাস পর্যন্ত অর্থনীতিতে যথেষ্ট ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। সংকট মোকাবিলার জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সে ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক লেনদেনে এখন যে চাপ রয়েছে, তা কতটা কমিয়ে আনা যায় সেটা ভাবতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমদানি নিয়ন্ত্রণেরও প্রয়োজন পড়বে। বিদেশে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ডলার নিয়ে যাওয়ার যে সুযোগ রয়েছে তাতে সরকারি নজরদারি রাখা দরকার। যেহেতু দেশে রিজার্ভ সংকট রয়েছে, অন্যদিকে টাকা বাইরে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, সে ক্ষেত্রে এটিকে কমিয়ে আনা দরকার। রেমিট্যান্সকে উৎসাহিত করার জন্য বাজারভিত্তিক রেমিট্যান্স মূল্য থাকা দরকার।
বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে যে শর্তাবলি রয়েছে সেগুলো যদি সহজ করা যায়, সময় যদি বাড়িয়ে নেওয়া যায় তাহলে কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক হবে বলে মনে হয়।
এক কোটি কার্ডের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষকে খাদ্য বিতরণের যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। এরা যেন রাজনৈতিক মহলের প্রভাব বিস্তারের বলিদান না হয়, সেদিকটাও আমাদের লক্ষ্য করতে হবে। বিভাগীয় পর্যায় থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে ব্যাপারটি খেয়াল রাখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনায় সুশাসন জরুরি।
অর্থনীতির এই চ্যালেঞ্জগুলো দূর করা সম্ভব না হলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হবে। বিদেশি অনুদান অথবা বিদেশি ঋণের ওপর ভিত্তি না করে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা দরকার। যারা কর এড়িয়ে যাচ্ছেন তাদের কীভাবে করের আওতায় আনা যায়, কীভাবে ডিজিটালাইজড সিস্টেম করে সবাইকে অনলাইনভিত্তিক সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসা যায়, সেই আধুনিকায়ন ব্যবস্থার দিকে জোর দিতে হবে। আগামী সময়গুলোয় দ্রুত অর্থনীতিকে স্বস্তিদায়ক অবস্থায় নিয়ে আসা কঠিন হবে। চেষ্টা থাকতে হবে এটি যেন দীর্ঘায়িত না হয়। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে নিয়মিত মনিটরিং ও সঠিক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই ধীরে ধীরে স্থির অবস্থানে ফিরে আসবে।
লেখক: গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)