Originally posted in যুগান্তর on 10 December 2022
চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেই ২০২৩ সাল থেকেই কিছু বড় প্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ধাক্কা শুরু হচ্ছে। এটি দিন দিন বাড়তেই থাকবে। ২০২৭ সালে গিয়ে সেটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। এ থাক্কা পরবর্তী আরও কয়েক বছর পর্যন্ত চলবে। বিশেষ করে আগামী বছর থেকে চীন, ভারত এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) ঋণের সুদ ও আসলসহ পরিশোধ শুরু হবে।
এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে রাশিয়া থেকে নেওয়া ঋণের গ্রেস পিরিয়িড (রেয়াত কাল) শেষ হয়ে ২০২৭ সালে শুরু হবে মূল ঋণের কিস্তি। ২০২৮ সালে শুরু হবে মেট্রোরেল প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ কার্যক্রম। এসবই দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, এর বাইরে অন্যান্য খাতে নেওয়া ঋণও সুদ ও আসল এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়েই প্রবল চাপে পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আগামী বছর থেকে ওইসব ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে রিজার্ভে চাপ আরও বাড়বে। এদিকে স্বল্পমেয়াদি বেশকিছু ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ জুন পর্যন্ত বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জুনের পর ওইসব ঋণ পরিশোধ শুরু হলে রিজার্ভে চাপ আরও বাড়বে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরজুড়েই রিজার্ভের ওপর চাপ থাকবে। বর্তমানে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৮০০ কোটি ডলার। স্বল্পমেয়াদি ঋণের কারণেই অর্থনীতিতে ঝুঁকির মাত্রা বেশি।
সূত্র জানায়, ধীরে ধীরে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২৭৮ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। ২০২৯-৩০ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ ৫১৫ কোটি ডলার খরচ হবে। এরপর ঋণ পরিশোধ কমতে থাকবে। বিদ্যমান ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আগামী ৩ বছর বাংলাদেশের ক্রমপুঞ্জীভূত ঋণের অঙ্কও বাড়তে থাকবে।
এদিকে বুধবার বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশ বেশ চাপে পড়েছে। ঋণ বাড়ার কারণে ঋণ ও আসল পরিশোধের মাত্রাও বেড়েছে। ২০২০ সালে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ৩৭৩ কোটি ডলারের ঋণ ও সুদ পরিশোধ করা হয়েছিল। এর মধ্যে মূলঋণ ২৮৭ কোটি ডলার এবং সুদ ৮৬ কোটি ডলার। গত বছরে একই খাতে ঋণ ও সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৫৩০ কোটি ডলার। এর মধ্যে আসল ৪২১ কোটি ডলার এবং সুদ ১০৯ কোটি ডলার।
২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ১৫৭ কোটি ডলার। এখন প্রতি বছরই পরিশোধের হার বাড়বে। এর বাইরে স্বল্পমেয়াদী ঋণও পরিশোধ করতে হচ্ছে। এগুলোর দায় আরও বেশি।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি আগেই বলেছি ঋণ পরিশোধের চাপ আসছে। এখন যেসব ঋণের সুদ বেশি এবং কঠিন শর্তযুক্ত সেগুলো নেওয়া থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া ঋণ পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এবং আয়ের মূল্যায়ন করতে হবে। বর্তমানে এই জায়গায় কোনো স্বচ্ছতা ও মূল্যায়ন নেই। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বড় চাপ আসলে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে সমস্যা তৈরি হবে। সেই সঙ্গে টাকার মান দুর্বল হতে পারে, বিনিয়োগ কমে যাবে, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিসহ নানা ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে সতর্ক ব্যবস্থা হিসাবে এখন থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে রিজার্ভের ওপর চাপ কমানো যায় কিনা সেই চেষ্টা করতে হবে।
৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে কথা বলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান। তিনি বলেন, আমরা এখনো সক্ষমতার দিক থেকে অনেক কম ঋণ নিচ্ছি। তবে আপাতত কম সুদে ও সহজ শর্তের ঋণ বেশি গ্রহণ করা হচ্ছে। কেননা আগামীতে এলডিসি উত্তরণ ঘটলে সহজ শর্তের ঋণ আর পাওয়া যাবে না।
তিনি আরও বলেন, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও কোনো সমস্যা হবে না। অতীতে বাংলাদেশ কখনও ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যায় পড়েনি এবং কোনো কিস্তিও বাকি পড়েনি। এবারও পড়বে না।
সূত্র জানায়, বর্তমানে চীনের কাছে বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে ২১টি ঋণ চলমান আছে। এর মধ্যে ৯টি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের ৬টি ঋণের রেয়াত কাল শেষ হবে। ফলে সুদ ও আসল মিলেই পরিশোধ শুরু হবে। এছাড়া ২০২৪ সালে পরিশোধ শুরু হবে একটি ঋণের সুদ ও আসল। ২০২৫ সালে শুরু হবে ৪টি ঋণের কিস্তি এবং ২০২৭ সালে শুরু হবে একটির কিস্তি।
এসব ঋণের বর্তমানে শুধু সুদের অংশ কিস্তি হিসাবে নেওয়া হচ্ছে। রেয়াতকালের পর সুদ ও আসল দুটো মিলেই পরিশোধ করতে হবে। চীনা ঋণের সাধারণত সুদ হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছরের মধ্যে এসব ঋণ পরিশোধ করতে হয়।
চীনের ঋণে বাস্তবায়ানীন উল্লেখযোগ্য একটি প্রকল্প হচ্ছে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ। ইতোমধ্যেই এ প্রকল্পের একটি টিউবের কাজ শেষে উদ্বোধন করা হয়েছে। এ প্রকল্পে চীনের ঋণ রয়েছে ১৯৫ কোটি ডলার। ২০২৩ থেকে শুরু হয়ে ২০৩১ সালের মধ্যে পুরো ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
অন্যান্য কয়েকটি প্রকল্প হচ্ছে-শাহজালাল সার কারখানা, দাশেরকান্দি পয়োবর্জ্য শোধনাগার, ইনফো সরকার-৩, মডার্নাইজেশন অব টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ফর ডিজিটাল কানেকশন, বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও বিতরণ ও সম্প্রসারণ ইত্যাদি। এসব প্রকল্পে ঋণের অর্থ ছাড় হয়ে গেছে। আগামীতে এসব ঋণও শোধ করতে হবে।
ইতোমধ্যে শাহজালাল সার কারখানা, পদ্মার পানি শোধনাগার ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন এ তিন প্রকল্পে পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত শত কোটি ডলারের মতো ঋণ পরিশোধ হয়েছে। বাকি প্রকল্পগুলোর চলতি বছর ও আগামী বছর থেকে শুরু হয়ে আগামী ১০ বছরে সব অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
এদিকে এআইআইবির বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে মোট ঋণ রয়েছে ১৪টি। এর মধ্যে দুটি ঋণের রেয়াতকাল শেষ হয়ে যাওয়ায় সুদ ও আসল পরিশোধ করা হচ্ছে। বাকি ১২টি ঋণের মধ্যে ২০২৩ সালের রেয়াতকাল শেষ হওয়ায় দুটি প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। ২০২৪ সালে শুরু হবে আরও ২টি প্রকল্পের। সবচেয়ে বেশি ২০২৫ সালে কিস্তি শুরু হবে ৬টি ঋণের। এছাড়া ২০২৬ এবং ২০২৭ সালে একটি করে ঋণের কিস্তি শুরু হবে। এ সংস্থার সুদের হার কিছুটা বেশি এবং কঠিন শর্ত রয়েছে।
ভারতের তিনটি এলওসি (লাইন অব ক্রেডিট) মিলে মোট ঋণ রয়েছে ৩টি। একেকটি ঋণে একাধিক প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে রেয়াতকাল শেষ হওয়ায় কিস্তি শুরু হবে দুটি ঋণের। ২০২৪ সালে শুরু হবে একটি ঋণের কিস্তি।
সূত্র জানায়, তিনটি এলওসির আওতায় গত এক যুগে ভারতের সঙ্গে প্রায় ৭৩৬ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। ভারতের ঋণের পরিশোধের সময়সীমা গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছর। সুদের হার ১ শতাংশ। তবে শর্ত হলো ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে অন্তত ৬৫ শতাংশ কেনাকাটা ভারত থেকে করতে হবে। এসব ঋণ প্যাকেজের আওতায় ৩০টির বেশি প্রকল্প চলছে। ছাড়ও হয়েছে ১০০ কোটি ডলারের বেশি। ইতোমধ্যে ১০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ পরিশোধ হয়েছে। ২০৩২ সালের মধ্যে বাকি ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
এদিকে ২০২৭ সাল থেকে রেয়াতকাল শেষ হয়ে যাচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ঋণের। প্রতিবছর দুটো করে কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। ২০২৭ সালেরই ২৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার করে দুটো কিস্তিতে দিতে হবে ৫৬ কোটি ৮ লাখ ডলার। যেটি এক বছরেই স্থানীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০০ টাকা ধরে) দাঁড়ায় ৫ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পে রাশিয়া মোট ঋণ দিচ্ছে ১ হাজার ১১৭ কোটি ডলার।
এর মধ্যে দেশটি ছাড় করেছে ৫০০ কোটি ডলার। বাকি আছে ৬১৭ কোটি ডলার। এ ঋণের সুদের হার লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফারড রেটের (লাইবর) সঙ্গে পৌনে ২ শতাংশ যোগ করে নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে ৬ মাস মেয়াদি ডলার বন্ডের সুদেও হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এর সঙ্গে পৌনে দুই শতাংশ যোগ করলে সুদের হার দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরের মধ্যে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (মেট্রোরেল)-লাইন-৬ এর আওতায় ঢাকা মহানগরীতে উত্তরা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের ব্যয় প্রথম ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাইকা সহায়তা দেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। পর্যায়ক্রমে জাইকা ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। এসব ঋণের রেয়াতকাল শেষে ২০২৮ সালে মূল ঋণ পরিশোধ শুরু হবে।