বণিক বার্তা
বাংলাদেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ও রফতানি বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক উৎপাদন চেইনে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। রফতানি খাতে আয় বৃদ্ধি শুধু প্রচলিত পণ্যের মাধ্যমে হচ্ছে না, নানা অপ্রচলিত পণ্যও সেখানে অবদান রাখছে। পরিসংখ্যান মোতাবেক, ২০০৫ সালে মোট রফতানিকৃত পণ্যের সংখ্যা ছিল ১৫৬৬ (এইচএস কোড অনুসারে), যা ২০১১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৫৭টি। প্রচলিত ও অপ্রচলিত এসব পণ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক উৎপাদন চেইনে যুক্ত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় শ্রমিকরাও সম্পৃক্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক উৎপাদন চেইনে। শ্রমিকদের এ সম্পৃক্ততা ঘটছে বিভিন্নভাবে— স্থায়ী শ্রমিক, অস্থায়ী শ্রমিক, চুক্তিভিত্তিক নিযুক্ত শ্রমিক, প্রাতিষ্ঠানিক স্বউদ্যোক্তা ও অপ্রাতিষ্ঠানিক স্বউদ্যোক্তা প্রভৃতি হিসেবে। বিভিন্নভাবে উৎপাদন চেইনে শ্রমিকের অংশগ্রহণ তার আয় ও সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করে কিনা তা অনেকাংশে নির্ভর করে বিভিন্ন খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, শ্রম-নিয়োজনের ধরন, কর্মপরিবেশ, উৎপাদনশীলতা, শ্রম-অধিকার কাঠামো পরিপালন, আইনি বাধ্যবাধকতা এবং শ্রমিকের সংগঠিত হওয়ার ও দরকষাকষি করার অধিকারের ওপর। অন্যভাবে উৎপাদন চেইনে শ্রমিকের অংশগ্রহণের প্রকৃতি, মাত্রা ও পরিবেশ প্রভৃতি শ্রমিক স্বার্থরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনক হলো, আন্তর্জাতিক উৎপাদন চেইনে অন্যান্য বিষয় (পণ্যমূল্য, পণ্যের গুণাগুণ ও উদ্যোক্তার মুনাফা প্রভৃতি) বিশেষ গুরুত্ব পেলেও শ্রম ও শ্রমিক-সংক্রান্ত বিষয়গুলো গুরুত্ব পায় অনেক কম। এর কারণ, ক্রেতা নির্দেশিত শ্রমঘন উৎপাদন চেইনে শ্রমিকের শ্রমের মূল্য অনেক কম। তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদন চেইনে শ্রমিকের জন্য বরাদ্দ মোট মূল্য সংযোজনের মাত্র ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে ক্রেতা, উৎপাদনকারী ও মূল কাঁচামালে (কাপড়) চলে যায় সিংহভাগ বরাদ্দ। শ্রমিকের এ প্রাপ্যতার সঙ্গে তার উৎপাদনশীলতার অনেক ফারাক। ফলে আন্তর্জাতিক উৎপাদন চেইনে শ্রমিকের অংশগ্রহণ হয়তো ন্যূনতম কাজের নিশ্চয়তা দিচ্ছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন জীবনমানের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ আজ এক আলোচিত বিষয়। আন্তর্জাতিক উৎপাদন চেইনে বিভিন্ন সনাতনী খাত (যেমন তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, পাটজাত দ্রব্য) দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকলেও শ্রমিকদের নিরাপত্তার পরিবেশ এখনো নিশ্চিত করা যায়নি সেভাবে। অতি সম্প্রতি সাভারে রানা প্লাজা ধসে পাঁচটি পোশাক কারখানার শত শত শ্রমিকের মৃত্যু এবং তার আগে তাজরীন ফ্যাশনসের মতো কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকের প্রাণহানি— পোশাক খাতের উৎপাদন চেইনের ‘ম্যাচিউরিটি’ নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে উত্তরোত্তর প্রবৃদ্ধির কারণে দেশে মানসম্পন্ন পোশাক কারখানা তৈরির প্রয়োজন ছিল। ২০০০ সালে মোট পোশাক রফতনি হয়েছে ১২৩ দশমিক ২ মিলিয়ন ডজন এবং ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডজন। বর্ধিত এ উৎপাদনের জন্য শুধু বর্ধিত শ্রমিকই প্রয়োজন হয়নি, একই সঙ্গে প্রয়োজন ছিল অবকাঠামো, বিশেষত সেসব শ্রমিকের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করবে। দুঃখজনক হলো, উৎপাদনকারীদের প্রচেষ্টায় অবকাঠামো গড়ে উঠলেও তা অনেক ক্ষেত্রেই মানসম্পন্ন নয়। আর এসব অবকাঠামোয় শ্রমিকের জন্য কর্মকালীন নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার চেষ্টা থাকলেও তা মোটেই যথেষ্ট ছিল না। তৈরি পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কারখানার মানসম্পন্ন ‘কমপ্লায়েন্স’ নিশ্চিত করা না গেলে এ খাতে আগামী দিনে অগ্নিকাণ্ড বা ধসের কারণে আরো মানবিক বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটবে বলে আশঙ্কা থেকে যায়।
আন্তর্জাতিক উৎপাদন চেইনে শ্রমিকের অংশগ্রহণ ও তার প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন আইনি সুরক্ষা রয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে শ্রমিকের অংশগ্রহণ, মজুরি, কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য। কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ক্রেতাদের নিজস্ব কোড অব কন্ডাক্ট রয়েছে। দুঃখজনক হলো— ক্রেতা-নির্দেশিত এসব উৎপাদন চেইনে শ্রমিক-সংক্রান্ত নিয়মনীতি প্রয়োগে ক্রেতা, উৎপাদক এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সদিচ্ছার ঘাটতি দেখা যায়। এতে করে শ্রমিক তার প্রাপ্য অধিকারটুকু সঠিকভাবে পান না। উৎপাদন চেইনে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় অংশগ্রহণের কারণে শ্রমিকদের প্রাপ্য সুবিধা বঞ্চিত হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তা নিম্ন ব্যয়ে উৎপাদন কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য আউটসোর্স করেন স্বউদ্যোক্তা/ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার কাছে অপ্রাতিষ্ঠানিক চুক্তির ভিত্তিতে। আবার উৎপাদন চেইনে নিযুক্ত শ্রমিকের বিভিন্ন দায় পাশ কাটাতে উৎপাদন করেন চুক্তিভিত্তিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রম নিয়োগ চুক্তি করে। এর মাধ্যমেও শ্রমিকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। তবে এটাও ঠিক, আন্তর্জাতিক উৎপাদন চেইনে পণ্যের চাহিদার ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে উৎপাদনকারীর ‘ফ্লেক্সিবিলিটি’ প্রয়োজন হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এ ‘ফ্লেক্সিবিলিটির’ সৃষ্টি করা হয় শ্রমিক-সংক্রান্ত সুবিধা কমানোর মধ্য দিয়ে।
শ্রমিকের মজুরি তার মানসম্পন্ন জীবন-জীবিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটি উৎপাদন চেইনে শ্রমিকের মজুরি আরো অনেক বিষয়ের মধ্যে মাত্র একটি। ফলে প্রতিনিয়ত শ্রমিককে সংগ্রাম করতে হয় মজুরি দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষত ন্যূনতম মজুরি, যথাসময়ে মজুরি প্রদান বা অতিরিক্ত কাজের যথাযথ পারিশ্রমিক প্রদান প্রভৃতির জন্য। পাশাপাশি প্রতি বছর মজুরি সমন্বয়ের যৌক্তিক বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। এছাড়া শ্রমিকের অন্যান্য যেসব অধিকার বা সুবিধা পাওয়ার কথা, তাও পরিপালন হয় না যথাযথভাবে। দুঃখজনক হলো, শ্রমিককে অনেক ক্ষেত্রেই উৎপাদন চেইনে শুধু এ প্রক্রিয়ার নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শ্রমিককে তার শ্রমের উপযুক্ত মর্যাদা দেয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের বস্তুতান্ত্রিক মনোভঙ্গি ক্ষতিকর। ফলে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শ্রমঘন শিল্পে শ্রমিকের দৈনন্দিন সমস্যাগুলো সঠিকভাবে সমাধান না হলে শ্রমিকের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করতে পারে; যার কারণে শ্রমিক অসন্তোষ ঘটতে পারে। শ্রমঘন শিল্পে সম্পর্ক জোরদার করতে মালিকের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ তাই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রমিকদের বিভিন্ন বিষয় দেখভাল করার দায়িত্ব আইনগতভাবে বিভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষের; যেমন— কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ, অগ্নিনির্বাপণ কর্তৃপক্ষ, শ্রম অধিদফতর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দুঃখজনক হলো, সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ লোকবল ও অর্থবলের অভাবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত নজর দিচ্ছে না। আবার এদের কেউ কেউ দুর্নীতির দায়ে দুষ্ট। ক্রেতাদের কোড অব কন্ডাক্ট পরিপালন হলেও শ্রমিক অধিকার অনেকাংশে রক্ষা করা যায়। তবে ক্রেতাদের কোড অব কন্ডাক্ট অনেক ক্ষেত্রেই ‘ভাসা ভাসা’ভাবে মানা হয়, যা শ্রমিক কল্যাণে পুরোপুরি কাজে আসে না।
দেখা যাচ্ছে, শ্রমিক কল্যাণের বিষয়টি আইনি কাঠামো এবং ক্রেতাদের নীতি কাঠামোর মাধ্যমে পর্যাপ্তভাবে নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা। কোনো কোনো খাতে ট্রেড ইউনিয়ন সক্রিয় এবং শ্রমিক স্বার্থ দেখভাল করছে। দুঃখজনক হলো, রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত পোশাকশিল্পে দীর্ঘদিন ধরে কারখানা পর্যায়ে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুবিধাজনক আইনি কাঠামো ছিল না। এতে শ্রমিকস্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত ছিল এবং দাবি আদায়ের জন্য অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সহিংস পথ বেছে নিতে হয়েছে। পোশাক খাতের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার বিচারে এ খাতে সুষ্ঠু ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান ও তা বাস্তবায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে ‘শ্রম আইন ২০০৬’-এর সংশোধনের মাধ্যমে কারখানা পর্যায়ে ট্রেড ইউনিয়ন করার পথ সহজতর হবে বলে অনুমিত হয়। সুষ্ঠু ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম নিশ্চিত করতে দুই পক্ষের কিছু মূলনীতি মেনে চলা দরকার। এর মাধ্যমে একদিকে আন্দোলনরত শ্রমিকরা দাবি আদায়ের কর্মকাণ্ডের জন্য কারখানা থেকে বহিষ্কার হবে না। অন্যদিকে মালিকপক্ষ আশ্বস্ত হবে, শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি উৎপাদন কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করবে না।
দেখা যাচ্ছে, উৎপাদন চেইনে শ্রমিকের অংশগ্রহণ সংশ্লিষ্ট খাতকে শক্তিশালী করলেও নিজ অবস্থানকে ততটা শক্তিশালী করতে পারেনি। কিন্তু উৎপাদনকারী দেশের সার্বিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন প্রভৃতির বিচারে শ্রমিকের অংশগ্রহণের পাশাপাশি তাদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করা জরুরি। এজন্য শুধু ক্রেতার কোড অব কন্ডাক্ট পরিপালনের ওপর জোর দিলে চলবে না, প্রয়োজন দেশীয় আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের দক্ষ ও সক্ষম হওয়া এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার যোগ্যতা অর্জন করা প্রয়োজন। সর্বোপরি প্রয়োজন মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সহাবস্থান।