Published in বণিক বার্তা on Monday, 3 June 2017
পাঁচ বছরে ব্যাংকিং খাতের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধস
ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছে দেশের জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ। আর্থিক লেনদেনের বড় অংশ এখনো ব্যাংকিং চ্যানেল-বহির্ভূত। প্রবাসী আয় প্রেরণও এর বাইরে নয়। অস্বাভাবিক কমে গেছে আমানতের সুদহার। সুশাসনের ঘাটতিতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এতে কমছে ব্যাংকিং খাতের প্রবৃদ্ধি। অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৭ এর তথ্য বলছে, পাঁচ বছরের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে। এ অবস্থায় আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি ব্যাংকিং খাতে আরো চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছেন সবাই।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৭-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে ব্যাংক খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে তা নেমে এসেছে ৮ দশমিক ২৩ শতাংশে। ২০১১-১২ অর্থবছরের পর এটাই ব্যাংকিং খাতের সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ব্যাংকিং খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৮৭, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৩৩, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৪৯ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
ব্যাংকিং খাতের এ অবনমনের মূলে রয়েছে সুশাসনের ঘাটতি। এ কারণে বাড়ছে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণও। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সাল শেষে দেশে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের এ পরিমাণ ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকায়। মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ খেলাপির খাতায় চলে গেছে।
ব্যাংকিং খাতে আমানতের সুদের হারও ধারাবাহিকভাবে কমছে। ব্যাংকগুলোর ২০১৬ সালের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের সুদহার ছিল গড়ে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা প্রায় ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় প্রস্তাবিত বাজেটে আমানতের ওপর বিভিন্ন মাত্রায় আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ও নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেনে উত্সাহিত হবে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বণিক বার্তাকে বলেন, অতিরিক্ত শুল্কারোপের কারণে নাগরিকদের সঞ্চয়প্রবণতায় প্রভাব পড়বে। এটি দেশের মানুষের ব্যাংকে সঞ্চয়ের প্রতি আগ্রহকে নিরুত্সাহিত করবে। বিশ্বের কোনো দেশেই এ ধরনের শুল্কারোপের বিষয়টি আমাদের নজরে আসেনি। ফলে সার্বিকভাবে আর্থিক খাতের সুবিধার্থে এ ধরনের পদক্ষেপ প্রত্যাহারের সুপারিশ করছি।
খেলাপি ঋণের বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে ক্রমবর্ধমান হারে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এ অবস্থায় সরকার অ্যাসেট রিকনস্ট্রাকশন কোম্পানি গঠন করে সংক্রমিত ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদগুলোর দেখভাল করতে পারে। এটা ব্যাংকগুলোর আয়-ব্যয়ের স্বাস্থ্যকে উন্নত করবে।
রাজস্ব বৃদ্ধির তাগিদে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, বছরের যেকোনো সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা বা উত্তোলন করলে তার ওপর বিদ্যমান ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক প্রযোজ্য হবে। ১০ লাখ টাকার ঊর্ধ্ব থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক দিতে হবে বিদ্যমান ১ হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া ১ কোটি টাকার ঊর্ধ্ব থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ৭ হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ১২ হাজার এবং ৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে জমা বা উত্তোলনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অবগারি শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাবকে অন্যায্য বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে ব্যাংকের সংখ্যা বাড়লেও প্রবৃদ্ধি ক্রমহ্রাসমান হারে কমছে। এর অর্থ হলো,খাতটিতে সুশাসনের ঘাটতি ও কার্যকর ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ত্রুটি রয়ে গেছে। এ অবস্থায় অবগারি শুল্ক বৃদ্ধি অন্যায্য পদ্ধতি হিসেবে কাজ করবে। প্রকৃত অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং করতে যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, সেটি বাধাগ্রস্ত হবে।
আমানতের সুদের হার ও মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করা হলে প্রকৃত আয় প্রায় শূন্যের কোটায় চলে আসে জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকের অন্যান্য সার্ভিস চার্জ, হিডেন কস্ট ও উেস করারোপসহ বেশ কয়েকটি ধাপে টাকা প্রদান করতে হচ্ছে গ্রাহককে। ফলে এখনই ১ লাখ টাকা জমা রেখে প্রকৃতপক্ষে ৯০-৯৫ হাজার টাকা মূল্য পাওয়া যাচ্ছে। নতুন করে আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি কোনোভাবেই সমর্থন করা যাবে না।
রাজস্বের উত্স হিসেবে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হলেও লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন বলে মনে করেন রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। তিনি বলেন, সরকার রাজস্বের একটি উত্স হিসেবে খাতটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এজন্য শুল্ক বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে এর কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়া গেলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা অবশ্যই এটি বিবেচনায় রাখবেন।