Originally posted in খবরের কাগজ on 6 October 2025
কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ফ্ল্যাট-প্লট
ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে যা ব্যয় হয়, বিক্রি করা হচ্ছে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে। এত বেশি দাম দিয়ে সাধারণ আয়ের মানুষের পক্ষে ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব হচ্ছে না বললেই চলে। অর্থনীতির বিশ্লেষকরা অভিযোগ করে বলেছেন, আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের অনেকে সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে ফ্ল্যাটের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করছেন এমন ব্যক্তিরাও একই মত জানিয়ে ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণ করে দিয়ে সরকারকে কঠোর নজরদারির পরামর্শ দিয়েছেন।
রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরে বাণিজ্যিকভাবে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বিক্রি করা হয়। এর বাইরে আবাসন ব্যবসা এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
আবাসন ও ঠিকাদারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকাভেদে ফ্ল্যাটের নির্মাণ ব্যয় কমবেশি হয়। রাজধানী ও চট্টগ্রামে যে খরচ হয়, অন্য বিভাগীয় ও জেলা শহরে তার তুলনায় কম পড়ে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তিন কাঠার জমিতে ১২শ বর্গ ফুটের একটি ফ্ল্যাট নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে খরচ হয় গড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা। পাইলিং, পাথর, রড, সিমেন্ট, ইট, বালু, টাইলস, বিভিন্ন ফিটিংস, দরজা-জানালা, প্লাম্বিং, স্যানিটারি, রংয়ের কাজ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, লিফট ও জেনারেটর, স্ট্রাকচারাল এবং আর্কিটেকচারাল ডিজাইন ও ডিজাইন অনুমোদনসহ বিভিন্ন খাতে খরচ আছে। বাজার মূল্যের সঙ্গে এসব খরচ বাড়ে বা কমে। এর সঙ্গে জমির দাম যোগ করে চূড়ান্ত দাম নির্ধারণ হয়। বর্তমানে মোহাম্মদপুরে ফ্ল্যাটের দাম সর্বনিম্ন প্রতি বগর্ফুট ৫ হাজার ৫শ টাকা। এই এলাকাতে দাম বেড়ে ১৩ হাজার ৫শ টাকা বা তার বেশি দামও বিক্রি হচ্ছে।
এই এলাকার ফ্ল্যাটের মালিক বেসরকারি ব্যবসায়ী রেহাত রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাজধানীতে মাথা গোঁজার একটা ঠিকানা দরকার ছিল। আমার গ্রামের জায়গা বিক্রি করে কিছু টাকা জোগাড় করি। আমার স্ত্রীর গহনা বিক্রি করি। আমার কিছু সঞ্চয় ছিল। সব কিছু মিলিয়ে আর একটি হোম লোন (গৃহঋণ) নিয়ে এই ফ্ল্যাট কিনেছি। ফ্ল্যাটের দাম আরও কম হওয়া উচিত। আমার এখন প্রতি মাসে হোম লোনে বড় অঙ্কের অর্থ চলে যায়। সংসারের খরচ চালিয়ে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।’
চাকরিজীবী (অবসর) সাহানা বেগম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার আর আমার স্বামীর সারা জীবনের সঞ্চয় জমিয়ে ধারদেনা করেও একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারিনি। এই বৃদ্ধ বয়সে কোথায় গিয়ে থাকব? কম দামে ফ্ল্যাট কিনতে পারলে ভালো হতো।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আমাদের দেশের আবাসন খাতেও বেশির ভাগ ব্যবসায়ী নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে ফ্ল্যাট ও প্লটের দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করছেন। যা প্রকৃত দামের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এভাবে আবাসন ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী হলেও সাধারণ মানুষ একটি ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, দেশের ধনী ব্যক্তিরাই কেবল ফ্ল্যাট ও প্লট কিনতে পারছেন। সাধারণ আয়ের মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় মিটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারা এত দাম দিয়ে কীভাবে এসব কিনবেন? এতে সাধারণ মানুষের আবাসন সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বরং বৈষম্য বাড়ছে। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন। এ বিষয়ে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি দরকার।
একই মত জানিয়ে আরেক অর্থনীতির বিশ্লেষক, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রকৃত দামের চেয়ে কিছু লাভ রেখে এলাকাভেদে ফ্ল্যাট ও প্লটের দাম নির্ধারণ করে দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের লাভ করার সুযোগ দিতে হবে। সাধারণ আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ফ্ল্যাট ও প্লটের দাম নিশ্চিত করতে হবে। বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে কি না তা কঠোর নজরদারি করতে হবে। কেউ নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করলে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে। তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।’
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি কে এইচ এম সফিকুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে এলাকা ভেদে ফ্ল্যাট ও প্লটের দাম সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দিতে হবে। ব্যবসায়ীরা যেন সরকারি দামে বিক্রি করেন তা নিশ্চিত করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার অভিজাত এলাকাতে ফ্ল্যাটের দাম অন্য এলাকার তুলনায় বেশি। প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম গুলশান-১ এলাকাতে ১৪ হাজার ৫শ টাকা, গুলশান-২ এলাকাতে ১৮ হাজার ৮শ টাকা, উত্তরাতে ৮ হাজার ৮শ টাকা, ধানমন্ডিতে ১০ হাজার ৫শ টাকা, সেগুনবাগিচাতে ৭ হাজার ৫শ থেকে ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত, মিরপুর-১৩ তে ৭ হাজার ৫শ থেকে ১০ হাজার টাকা, মিরপুর ডিওএইচএস এলাকাতে ৬ হাজার থেকে ১৩ হাজার ৫শ টাকায় ফ্ল্যাট বিক্রি হয়। বসুন্ধরা এলাকায় ৯ হাজার ৫শ থেকে ১৩ হাজার টাকায় ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে।
মানুষের ৫টি মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো বাসস্থান তথা আবাসন। প্রতিটি মানুষের যথোপযুক্ত বাসস্থান পাওয়ার অধিকার জাতিসংঘের ঘোষণায় নিশ্চিত করা হয়েছে। দেশের সংবিধানেও বাসস্থানকে মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সব মানুষের স্বপ্ন থাকে সুন্দর একটা বাড়ি করার। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে ঘরে ফিরে সবাই ফেলতে চায় একটু স্বস্তির নিশ্বাস। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত সবারই ন্যূনতম চাওয়া একটা সুন্দর নিজস্ব ঠিকানা। নিজের একটা ঠিকানা শুধু না। নিজের একটা বাসস্থান মানুষের স্থিতিশীলতা, আত্মমর্যাদা এবং ব্যক্তিত্বকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়।
রিহ্যাবের সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, আবাসন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমরা সবাই চেষ্টা করছি দেশের নাগরিকদের জন্য সুন্দর আবাসন গড়ে তুলতে। অনেক রকম প্রতিবন্ধকতায় তা পারছি না। এখানে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। বিশেষ করে নিবন্ধন করসহ অন্যান্য খরচ কমানো এখন সময়ের দাবি। এটা হলে ফ্ল্যাট ও প্লটের দাম কিছুটা হলেও কমবে।