সরকারের উচিত আমিন জুট মিলসে নতুন বিনিয়োগের পথ খোঁজা – ড. মোয়াজ্জেম

চট্টগ্রামের আমিন জুট মিলস

Originally posted in প্রথম আলো on 5 September 2025

বন্ধ কারখানায় ব্যয় শতকোটি টাকা

দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকায় কারখানার সরঞ্জামে ধরেছে মরিচা। কারখানা ভবনের অনেক স্থানে পলেস্তারাও খসে পড়েছে। চুরি হয়ে গেছে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। পাঁচ বছর আগে এ কারখানার উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তাই বিশাল এলাকাজুড়ে থাকা কারখানাটি এখন অনেকটা ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়েছে।

আর বন্ধ এ কারখানা পরিচালনার জন্য গত চার অর্থবছরে খরচ হয়েছে মোট ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ খরচ ৩৩ কোটি টাকার বেশি। কারখানাটি হলো চট্টগ্রাম নগরের আমিন জুট মিলস। ৭১ বছর আগে এই পাটকল চালু হয়েছিল। ২০২০ সালের ১ জুলাই কারখানাটি বন্ধ করে দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তাতে চাকরি হারান প্রায় চার হাজার শ্রমিক। এখন কারখানা বন্ধ থাকলেও প্রশাসনিক কাজে যুক্ত আছেন ১২৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী।

চট্টগ্রাম নগরের আতুরার ডিপো এলাকায় প্রায় ৮০ একর জমির ওপর আমিন জুট মিলস লিমিটেড অবস্থিত। ১৯৫৪ সালে এটি স্থাপিত হয় এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর এটিকে জাতীয়করণ করা হয়। সে সময় আমিন জুট মিলস ও আমিন ওল্ড ফিল্ডস—এ দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীন চলে আসে। চট্টগ্রামে বিজেএমসির ৯টি পাটকলের মধ্যে সবচেয়ে বড় আমিন জুট মিলস।

উৎপাদন বন্ধ, তবু শতকোটি ব্যয়

বন্ধ এই পাটকলের পেছনে গত চার অর্থবছরে পরিচালন বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। প্রশাসনিক কাজের জন্য বর্তমানে প্রকল্প পরিচালক, উৎপাদন ব্যবস্থাপক, অন্যান্য কর্মকর্তা, নিরাপত্তা প্রহরীসহ শতাধিক লোক কর্মরত রয়েছেন। তাঁদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতিবছর গড়ে ৮ কোটি টাকা করে মোট ৩২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে এই চার বছরে। আর বন্ধ কারখানার বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়েছে চার বছরে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি। এ ছাড়া জ্বালানি, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিমাসহ বিভিন্ন খাতে বাকি অর্থ ব্যয় হয়। আমিন জুট মিলসের নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় নিয়ে প্রতি অর্থবছরে নিয়মিত নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। সর্বশেষ ২০২০-২১ থেকে ২০২৩-২৪—এই চার অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে কারখানাটির লোকসানের তথ্য পাওয়া গেছে।

শতকোটি টাকা খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প প্রধান) এ এইচ এম কামরুল হাসান বলেন, ‘আমাদের ২৫০-এর বেশি ভাড়াটে আছে। তাদের বিদ্যুতের বিলও আমাদের মিটারে আসে। ১২৫ জনের বেশি কর্মকর্তা আছেন। পরিচালন ব্যয় সাত-আট কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা না। বাকিটা নথি দেখে বলতে হবে।’

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত আমিন জুট মিলসের মোট লোকসানের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি। উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শেষ চার অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ৫৩ কোটি টাকা। উৎপাদন বন্ধ থাকলেও অবশ্য আয় বন্ধ হয়নি আমিন জুট মিলসের। চার বছরে প্রতিষ্ঠানটি আয় করেছে ৪৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। মূলত কারখানা বন্ধ হওয়ার আগে উৎপাদিত পণ্য, স্ক্র্যাপসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বিক্রি করে এ অর্থ আয় করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

বন্ধ কারখানার পেছনে চার বছরে শতকোটি টাকা খরচে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আমিন জুট মিলস সিবিএর সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক। ১৯৭৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কারখানায় কাজ করা এই শ্রমিকনেতা বলেন, শ্রমিক নেই, কারখানাও বন্ধ, কর্মকর্তারা বসে বসে বেতন নিচ্ছেন। মানুষের কষ্টের টাকা এভাবে খরচ করার কোনো মানে হয় না। আবার জায়গাও দখল হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তা উদ্ধারেও কোনো তৎপরতা নেই কর্তৃপক্ষের।

জমি বেদখল, যন্ত্রাংশ চুরি

নগরের চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কের আতুরার ডিপো এলাকায় অবস্থিত প্রায় ১৫০ একর জায়গায় তিনটি কারখানা রয়েছে। এই পুরো এলাকা স্থানীয়ভাবে আমিন শিল্প অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। মূল কারখানা ছাড়া আশপাশের অনেক জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। তবে কী পরিমাণ জায়গা বেদখল রয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। আবার কারখানার যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও আশপাশে বিভিন্ন স্থাপনার সামগ্রীও চুরি হয়ে গেছে। শ্রমিকদের থাকার ২১টি কোয়ার্টারের কোনোটির জানালা, গ্রিল, দরজা, টিন চুরি হয়ে গেছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে আমিন জুট মিলস এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ২১টি কোয়ার্টারের মধ্যে শুধু একটি বাসযোগ্য। সেটিও জরাজীর্ণ। অন্যগুলো পরিত্যক্ত। কারখানার বর্জ্য যাওয়ার খালের পাশে অন্তত ৩০টি ঘর ও দোকানের ভাড়া এখন আর কারখানা পাচ্ছে না। এগুলো একসময় শ্রমিকদের থাকার জন্য নামমাত্র মূল্যে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। তবে এখন সেগুলো বেদখল।

জমি বেদখলের বিষয়ে প্রকল্পপ্রধান এ এইচ এম কামরুল হাসান বলেন, কারখানার কিছু জমি একটি আবাসন নির্মাণপ্রতিষ্ঠানের নামে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশ জরিপে। এসব জমির দখল ফিরিয়ে আনতে মামলা চলছে।

এদিকে কারখানাটির চলমান অবস্থা নিয়ে ক্ষুব্ধ কারখানার সাবেক শ্রমিকেরা। কারখানার তাঁত বিভাগের সাবেক শ্রমিক মো. কামাল উদ্দীন বলেন, এখনো অনেক শ্রমিকের পাওনা বাকি। অথচ বসে বসে বেতন নিচ্ছেন কর্মকর্তারা। কারখানা চালুর কোনো উদ্যোগ নেই তাঁদের। পুরোনো অধিকাংশ যন্ত্রপাতি দরপত্র ছাড়াই বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।

তবে শ্রমিকদের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কারখানা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কারখানা কর্তৃপক্ষের দাবি, নিয়ম মেনে দরপত্রের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি ও স্ক্র্যাপ বিক্রি করা হয়।

আমিন জুট মিলসে বিকল্প বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার এখন বিভিন্ন খাতে ব্যয় সংকোচন করছে। সেখানে এই প্রতিষ্ঠানে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী বসে বসে বেতন নিচ্ছেন। আমরা মনে করি, এখানে বিকল্প বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অঞ্চল বা এ ধরনের কিছু করা উচিত। সরকারের উচিত এ ধরনের (লোকসানমুখী) শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে সরে আসা।’