Originally posted in সমকাল on 18 November 2022
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ২০১৭ সাল থেকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে ২০০৭ সাল থেকে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সিপিডিতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ১৯৮৬-২০১২ মেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে অধ্যাপনা করেন। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ইউক্রেনের খারকিভ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৮১ সালে স্নাতকোত্তর এবং রাশিয়ার মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৮৫ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ইব্রাহিম মেমোরিয়াল স্বর্ণপদক পেয়েছেন। মোস্তাফিজুর রহমানের জন্ম ১৯৫৫, ফেনীতে।
সমকাল: শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া একটি দেশের হঠাৎ আইএমএফের ঋণ প্রয়োজন হচ্ছে কেন?
মোস্তাফিজুর রহমান: একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ এবারই প্রথম আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছে না। এর আগেও বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন সময়ে ঋণ নিয়েছে। সম্ভবত এর আগে ১২ বার এ ঋণ নেওয়া হয়েছিল। আমি মনে করি, এবার ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হওয়ার দুটো দিক আছে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমরা উচ্চমূল্যের দিকে যাচ্ছি। তার চাপ এসে রিজার্ভের ওপর পড়েছে। এ জন্যই গত বছর আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি ৩০ বিলিয়ন ডলার দেখতে পেয়েছি। রেমিট্যান্স দিয়ে এসব ক্ষেত্রে আমরা চলতি বছরের ঘাটতি মেটাতে পারতাম। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেখানেও লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না। রেমিট্যান্স কমে গেছে। এসবের ফলে অর্থনীতিতে সামগ্রিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমাদের রিজার্ভ কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, একই সঙ্গে আর্থিক খাত বা প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বেশকিছু সংস্কার দরকার ছিল। এসব সময়মতো না করায় সমস্যা আরও গভীর হয়েছে।
সমকাল: যেমন-
মোস্তাফিজুর রহমান: কয়েকটি দিকের কথা বলি। আমাদের যে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, সেখানে এখন টাকার অবমূল্যায়ন দেখতে পাচ্ছি। এর ফলে আমাদের রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমাদের রেমিট্যান্স যাঁরা নিয়ে আসছিলেন, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া বৈধ চ্যানেল, হুন্ডি, সরকারি অন্যান্য ব্যবস্থা- এসবের সঙ্গে মুদ্রার মূল্যগত যে ব্যবধান, এসব মিলিয়েও ইনফরমাল পথে অনেক টাকা চলে গেছে। এ ছাড়া আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল টাকা বিদেশে চলে গেছে। এসব দিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। আমাদের যে দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে; বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট রয়েছে; এগুলোর ক্ষমতা ও তদারকি আরও বাড়াতে হবে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয়নি, এমনও ঘটেছে। এভাবে প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে।
সমকাল: এসব বিষয়ে অনেক বার বিভিন্ন পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা কিন্তু দেওয়া হয়েছিল।
মোস্তাফিজুর রহমান: আইএমএফ সে সতর্কবার্তা দিয়েছিল, আমরা নিইনি। আমরা ভেবেছিলাম, রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরেই আছে। প্রকৃতপক্ষে রিজার্ভ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার খরচের বাইরে থাকবে। সেটি আলাদা করে হিসাব করা হয়নি।
সমকাল: আইএমএফের ঋণ কি আমাদের স্বস্তি দেবে?
মোস্তাফিজুর রহমান: আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। এটা অবশ্যই স্বস্তির খবর। তবে অর্থের অঙ্কে এই ঋণ তেমন বড় কিছু নয়। এই ঋণের অর্থ দিয়ে আমাদের সব সমস্যা তো মিটবে না। আবার সব অর্থও আমরা একসঙ্গে পাব না। প্রথম কিস্তিতে বাংলাদেশ ৪৫ কোটি ডলার পাবে। এটি আমাদের রিজার্ভের সাপেক্ষে তেমন কিছু নয়। তারপরও এই ঋণ বাংলাদেশে লেনদেনের ভারসাম্যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে এই ঋণের যেটি গুরুত্ব আমার কাছে মনে হয়েছে, আইএমএফের ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হওয়ার খবরে এক ধরনের বার্তা আছে। এটি বহুপক্ষীয় অন্যান্য সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিাভন্ন সংস্থাকে আশ্বস্ত করবে। তাদের বাজেট সহায়তা দিতে উৎসাহিত করবে। বাজেট সহায়তাও কিন্তু রিজার্ভে যোগ হয়। সেদিক থেকে এর গুরুত্ব আছে।
সমকাল: বাজেট সহায়তা পেলেই কি সমস্যার সমাধান হবে?
মোস্তাফিজুর রহমান: ঋণের সঙ্গে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, এনবিআরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, জ্বালানি খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ- এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। সুশাসনের অভাবের কথাও অনেক বছর ধরে আলোচিত। শুধু রিজার্ভ নয়; ব্যয় করার মতো অর্থেরও অভাব আছে আমাদের। সংস্কারগুলো নিজেদেরই আগে থেকে করা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা এত দিন করিনি। এখন আইএমএফ বলার পর যদি করা হয়, তাহলে এটাও ভালো দিক। আমরা সংস্কার করে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারলে আমাদেরই লাভ। আর্থিক খাতে সংস্কার আমাদের গরজেই করতে হবে। এসব করা গেলে আমাদের খেলাপি ঋণ কমবে বা রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি পাবে।
সমকাল: আইএমএফের ঋণের শর্ত নিয়ে নানা আলোচনা আছে। সহজ নাকি কঠিন- এসব নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য শোনা গেছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
মোস্তাফিজুর রহমান: কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত দেবে- এটাই স্বাভাবিক। সেখানে আইএমএফের শর্ত তো থাকবেই। আইএমএফের আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল মুদ্রার বিনিময় হার বাজারমুখী করা। এটি নতুন কিছু নয়। দেশের অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই এ কথা বলে আসছেন। আইএমএফ ভর্তুকি হ্রাসের কথা বলেছে। তবে কোন খাতে সমন্বয় করব, তা আমাদেরই নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা যেন হুমকির মুখে না পড়ে, তা বিবেচনায় নিতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো, আইএমএফের এই ঋণের সুদহার ২ শতাংশের ওপরে। এটা যে একেবারে কম, তা নয়। তবে বাণিজ্যিক ঋণের চেয়ে কম, যার হার ৪-৫ শতাংশ। এই ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে যেন আমরা অসুবিধার সম্মুখীন না হই, তা দেখতে হবে। এই ঋণের অর্থ কিস্তিতে আসবে। প্রথম কিস্তি আসার পর মূল্যায়ন হবে, আমরা কতটা সংস্কার করতে পেরেছি। তার ভিত্তিতে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ আসবে।
সমকাল: আর্থিক সংস্কার কেন অপরিহার্য হয়ে উঠল?
মোস্তাফিজুর রহমান: করোনা মহামারির ধাক্কা আমরা মোকাবিলা করেছি। তা শেষ হতে না হতে শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এসবের বাইরে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা, খেলাপি হয়ে যাওয়া, মোটা দাগে দুর্নীতি, অর্থ পাচার তো রয়েছেই।
সমকাল: বিশেষত খেলাপি ঋণের মাত্রা নিয়ে অনেক দিন ধরেই সমালোচনা রয়েছে।
মোস্তাফিজুর রহমান: এ দেশে বৈধ পথে যাঁরা আয় করেন তাঁদের জন্য তেমন কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকে না, যেমনটা থাকে কালো টাকার মালিকদের ক্ষেত্রে। ঋণের ক্ষেত্রেও এ ধরনের পরিস্থিতি রয়েছে। ফলে অনেকে ইচ্ছা করেই ঋণখেলাপি হন। এসব ক্ষেত্রে শূন্য সহিষুষ্ণতা দেখা যায় না। সমস্যা হচ্ছে, এই বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে প্রভিশনিং করে রাখতে হচ্ছে। এতে আবার ব্যাংকগুলোর ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের সুদহার, বিনিয়োগ- সবকিছুর ওপর এগুলোর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। খেলাপি ঋণের অর্থ অর্থনীতিতে এলে রিজার্ভ থেকে শুরু করে বৈদেশিক লেনদেন- সবকিছুতেই ইতিবাচক প্রভাব পড়ত।
সমকাল: রুগ্ণ অর্থনীতিকে সবল করতে কী করা উচিত?
মোস্তাফিজুর রহমান: আমি মনে করি, ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক সুশাসন ও সংস্কারে নজর দেওয়া উচিত। তা না হওয়ায় সরকারই বিপদে পড়েছে। আইএমএফের শর্তের কারণে নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন থেকেই আমাদের আর্থিক খাতে সংস্কার করা উচিত। আর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কার আশা করা যায় না। বর্তমান বাস্তবতায় আমরা সাময়িক সময়ের জন্য ব্যাংকিং কমিশনের কথা বলেছি। কিন্তু সে বিষয়ে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে বলা যায়, দেশের অর্থনীতি ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এখন অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে তুলতে শূন্য সহিষুষ্ণতা দেখাতে হবে। তবে কাজটা সহজ না। বিভিন্ন কায়েমি গোষ্ঠী বাদ সাধবে। সে জন্যই বলেছি, সরকারকে দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার প্রয়োগ করতে হবে।
সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।
মোস্তাফিজুর রহমান: সমকালকেও ধন্যবাদ জানাই।