Originally posted in সমকাল on 19 February 2022
দেশে ঋণখেলাপি, করখেলাপিরা সরকার ও অর্থমন্ত্রীর চেয়েও শক্তিশালী। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি উদ্ঘাটন ও ব্যবস্থা নিতে সংসদে দাঁড়িয়ে দুই বছর বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংক কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েও অর্থমন্ত্রী তা করতে পারেননি। ব্যাংক মালিকদের অ্যাসোসিয়েশন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে কোটি কোটি টাকা দিয়ে সুবিধা বাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝরাতে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সভা করে ঋণখেলাপিকে ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দিচ্ছে, পরদিন তিনি সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছেন।
শনিবার রাজধানীর এফডিসিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে ‘আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি নেই’ শীর্ষক ছায়া সংসদের বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালন করবেন, তারা যেন খেয়াল রাখেন, কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ মধ্যরাতে সভা করে কাউকে ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দিয়ে নিচ্ছে কিনা। আগামী নির্বাচনে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী, ঋণখেলাপি, বিলখেলাপি, করখেলাপিকে যাতে মনোনায়ন দেওয়া না হয়- সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, যেদিন সরকার আইন করে একই পরিবার থেকে ব্যাংকে অধিক সংখ্যক পরিচালক নিয়োগের বৈধতা দিয়েছে এবং তাদের পুনর্নিয়োগ পরপর দুইবারের পরিবর্তে তিন করার সুযোগ দিয়েছে, সেদিনই আর্থিক খাতের দুর্নীতি কমাতে সরকারের সদিচ্ছার বড় ঘাটতি দেখেছি। বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার মোট ঋণের ১০ শতাংশ। এটা বিভ্রান্তিকর তথ্য। সত্যিকার প্রভিশনিং এবং অবলোপন হিসাব করা হলে খেলাপি ঋণ অন্তত তিন গুণ। খেলাপি ঋণ যতটা আদায় হয়, তার তিন-চার গুণ অবলোপন করা হয়।
সিপিডির এই সম্মাননীয় ফেলো বলেন, এই খাতের দুর্নীতি কমাতে সরকারের নীতি ও আইনের অভাব আছে- এ কথা খুব কম লোকই বলেন। দুর্নীতি রোধে প্রক্রিয়ারও অভাব নেই। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ যথেষ্ট কাঠামোও আছে। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে সর্বজনীনতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে আর্থিক খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করতে সরকার একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, অর্থনীতি হূৎপিণ্ড হলে তাতে আর্থিক খাত তার ধমনি। কোনো কারণে ধমনিতে রক্ত সঞ্চালন আটকে গেলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। এ খাতের দুর্নীতি বন্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আছে, কিন্তু তার নজরদারি কোথায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আছে, সংসদে সংসদীয় কমিটি আছে; তারা এ নিয়ে কয় দিন আলোচনা করেছেন, কাকে জবাবদিহির মুখোমুখি করেছেন। তারাও তো সরকারের অংশ।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আর্থিক খাতের দুর্নীতি জাতীয় সমস্যা, রাজনীতির বিভেদ ও ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একে জাতীয়ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। আসন্ন নির্বাচনের আগে সরকারকে দেখাতে হবে- আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে আগের নির্বাচনে যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েছিল, তা কতখানি বাস্তবায়ন করেছে। আগামী নির্বাচনের ইশতেহারে সব দলকে সুনির্দিষ্ট করতে হবে- এ ক্যান্সার থেকে জাতিকে রক্ষা করতে তারা কী করবেন।
ঋণখেলাপি ও বিলখেলাপিদের সামাজিকভাবে বর্জন করা দরকার মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কতটা সামাজিক ঘৃণা ছড়াতে পেরেছি। আমরাই তো তাদের প্রধান অতিথি করে অনুষ্ঠান আয়োজন করি, কিছু পাওয়ার চেষ্টা করি।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য বিনিয়োগ দরকার, তার জন্য দেশি বা বিদেশি উৎস থেকে অর্থায়ন দরকার। বাংলাদেশের বর্তমান প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সরকারি ব্যয় থেকে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির তুলনায় ২৩ শতাংশে আটকে আছে। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও দক্ষতা না থাকা এর বড় কারণ। আবার সরকারি বিনিয়োগ আরও বাড়াতে যে কর আদায় বাড়ানো দরকার, তাও হচ্ছে না; কর-জিডিপি অনুপাতও বহু বছর ১০ শতাংশে আটকে আছে। আমরা বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা কমিয়ে আনছি, এটা ভালো কথা; কিন্তু সরাসরি বিনিয়োগ আমরা জিপিডির ১ শতাংশের ওপরে ওঠাতে পারছি না।
সভাপতির বক্তব্যে হাসান আহমেদ কিরণ অর্থ পাচার ও ঋণ জালিয়াতি বন্ধে সরকারের কাছে ১০ দফা সুপারিশ করেছেন। তার সুপারিশের মধ্যে ব্যাংক কমিশন গঠন, ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের তালিকা সংসদের মাধ্যমে প্রকাশ, পাচারকৃত ও খেলাপি ঋণের টাকা ফিরিয়ে আনা, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের বিদেশ পালানো ঠেকাতে ব্যবস্থা গ্রহণ, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক গঠন বন্ধ ও অভিজ্ঞদের দিয়ে ব্যাংকের পর্ষদ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ, লোকসানি ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কমিটি গঠন, সুইস ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকে পাচারকৃত অর্থের তথ্য ও তা ফিরিয়ে আনতে সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে চুক্তি করা অন্যতম।
শনিবারের বিতর্ক অনুষ্ঠানে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা আর্থিক খাতের দুর্নীতি ও সুশাসন বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে বিতর্ক করেন। এতে বিচারকের ভূমিকায় ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার রেজাউল করিম কৌশিক, একাত্তর টিভির সিনিয়র রিপোর্টার কাবেরি মৈত্রিয়, চ্যানেল আইয়ের বিজনেস এডিটর রিজভী নেওয়াজ এবং ড. এস এম মোর্শেদ।