আর্থিক সহযোগিতার পরিধি বাড়ান – খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Originally posted in সমকাল on 19 April 2021

এপ্রিলের শুরু থেকেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুহারও। তাতে মানুষের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রথম পর্যায়ে গত ৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। পরে প্রথম পর্যায়ের লকডাউন আরও দু’দিন বৃদ্ধি করা হয়েছে। ১৪ এপ্রিল থেকে আবার সাত দিনের লকডাউন ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। অবস্থা বিবেচনায় তা বাড়তে পারে। লকডাউনের মূল উদ্দেশ্য করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা। তবে লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। লকডাউনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব রাখতে হবে। সরকারি প্রজ্ঞাপনে লকডাউন চলাকালে সীমিত আকারে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সমন্বয় থাকতে হবে, যেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অধিক গুরুত্ব লাভের দাবিদার।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পরিপালন করতে হবে। বিগত সময়ে এক্ষেত্রে অবহেলা ও ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। গত বছর দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের পর শুরুর দিকে মাস্ক পরিধান, হাত ধোয়া বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার যে অভ্যাস গড়ে উঠেছিল, সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ তা কমে আসে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কলকারখানাগুলোতে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এখনও সর্বত্র স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে এক ধরনের অনীহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লকডাউনে কলকারখানা চালু রাখার সিদ্ধান্ত খুবই ইতিবাচক। তবে সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানা হচ্ছে কিনা তা সুনিশ্চিত করা জরুরি। এ ব্যাপারে শুধু কারখানাগুলোর ওপর নির্ভরশীল না থেকে সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন এবং সরকারের সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন সংস্থাকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।

স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে কোনোক্রমেই শিথিলতা প্রদর্শন কাম্য নয়। এই মুহূর্তে আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা চালু থাকার কারণে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হতে পারে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য বিভাগসহ সরকারের সংশ্নিষ্ট বিভাগগুলোর উদ্যোগে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা কঠিন। এখন যেহেতু সব ধরনের সরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ ছুটির আওতায় রয়েছে, কাজেই স্বাস্থ্য খাতের বাইরের সরকারি কর্মীদের মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানো যেতে পারে। পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি এ কাজে তাদের সহায়তা করতে পারে। কোনো কারখানা স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে অবহেলা প্রদর্শন করলে প্রয়োজনে অর্থদণ্ড করা বা সাময়িকভাবে সেই কারখানা বন্ধ ঘোষণার মতো ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু প্রতিষ্ঠানকে দণ্ডিত করলেই চলবে না, কেউ ব্যক্তিপর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করলে তাকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে, প্রয়োজনে অর্থদণ্ড করতে হবে।

আমরা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নই লকডাউন আসলে কতদিন থাকবে। এ যাত্রায় ৯ দিন দেশে এক ধরনের লকডাউন চলেছে এবং ১৪ এপ্রিল থেকে আরও সাত দিন লকডাউনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সাত দিনের লকডাউন করোনা সংক্রমণ রোধে কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়ে অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, লকডাউন একটানা অন্তত ১৪ দিন হওয়া দরকার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২৮ দিনও হতে পারে। কাজেই লকডাউনের মেয়াদের ওপর সরকারি সহযোগিতার বিষয়টি নির্ভর করছে। গত বছর করোনা সংক্রমণের পর সাধারণ ছুটির ঘোষণা আসার আগেই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ঘোষণা এসেছিল। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত সে রকম কোনো ঘোষণা আসেনি। এর কারণ হতে পারে সরকার হয়তো দীর্ঘকালীন লকডাউনের চিন্তা করছে না। সরকার হয়তো সীমিত আকারে স্বল্পকালীন লকডাউনের বিষয়ে ভাবছে, যাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা যায় এবং সাধারণ মানুষ সীমিত পরিসরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে টিকে থাকতে পারে।

কিন্তু লকডাউন যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় এবং সেখানে যদি সরকারিভাবে কোনো অর্থনৈতিক সহযোগিতা না থাকে, তাহলে সীমিত আয়ের মানুষ, পরিবহন শ্রমিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী এবং ক্ষুদ্র খামারিরা বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের মুখোমুখি হতে পারে। সরকারের বিবেচনায় এ বিষয়টি রাখা দরকার। এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক সহযোগিতার কাঠামোটি সরকারের পরিকল্পনায় নিয়ে আসা জরুরি, যাতে সময়মতো তাদের সহায়তা পৌঁছে দেওয়া যায়।

গত বছরের সাধারণ ছুটি আর এ বছরের লকডাউনের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। গত বছর সাধারণ ছুটির সময় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ যথেষ্ট স্থিতিশীল ছিল। চালের মূল্য স্থিতিশীল ছিল। ফলে এ ধরনের সংকটে মূল্যস্ম্ফীতির মতো যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়ে থাকে, তা গত বছর তেমনভাবে দৃশ্যমান হয়নি। অবশ্য সাধারণ ছুটির পরে বাজারে মূল্যস্ম্ফীতি দেখা দেয়, যা এখনও বিদ্যমান। বাজার এখন যথেষ্ট মাত্রায় অস্থিতিশীল এবং বলা হচ্ছে চালসহ কিছু জরুরি পণ্যের যথেষ্ট সরবরাহ নেই। সরকারি ভান্ডারে চালের স্টকও সীমিত। কাজেই চাল আমদানি করা দরকার। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের উচিত হবে মাঠ পর্যায়ে চলমান ওএমএস কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো। এই কার্যক্রম বড় বড় শহরের পাশাপাশি উপশহর এমনকি থানা পর্যায়েও সীমিত আকারে পরিচালনা করার দরকার হতে পারে।

নিম্ন আয়ের মানুষ বিশেষত যারা দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য সরকারের যে কার্যক্রমগুলো রয়েছে সেগুলোর পরিধি বাড়াতে হবে। উপরন্তু যদি দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনের পরিকল্পনা থাকে তাহলে গত বছরের মতো এ বছর সরকার তাদের এককালীন অর্থ প্রদান করতে পারে। গত বছর মাথাপিছু আড়াই হাজার টাকা করে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল, তার ৭২ শতাংশ সরবরাহ করা গেছে। এখনও ২৮ শতাংশ অবশিষ্ট রয়েছে। প্রয়োজনবোধে এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং গত বছর যারা এই সহায়তা পেয়েছে তাদের আবারও তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সীমিত আয়ের অনেক মানুষ কোনো ধরনের সহযোগিতার তালিকাভুক্ত হননি। তারা এ বছরও বঞ্চিত হতে পারেন এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। তাদের তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে ত্বরিত কোনো ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকাগুলো বিশেষ করে বস্তি, চর ও প্রত্যন্ত এলাকায় সরকার ওএমএসের কার্যক্রম বাড়িয়ে সেসব ক্ষেত্রে অধিক পণ্য সরবরাহ করতে পারে এবং পণ্যের মূল্য কমিয়ে দিতে পারে। অন্তত তারা যেন শেষ সঞ্চয়টুকু দিয়ে হলেও টিকে থাকতে পারে, এ ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে।

 

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)