Originally posted in প্রতিদিনের বাংলাদেশ on 23 January 2025
ঋণখেলাপিদের জন্য আসছে বিশাল ছাড়
ঋণ শ্রেণীকরণ, সুদ মওকুফ এবং খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মতো তিন নীতিতে ছাড় দিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে নীতি সহায়তা দেওয়া হলেও এবার আর ঢালাও ছাড় পাওয়ার সুযোগ থাকছে না। তাই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের সুবিধা দিতে একটি মনিটরিং টিম গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিদ্যমান নীতি পর্যালোচনা করে ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্র চিহ্নিত করবে এ কমিটি।
জানা গেছে, ঢালাও ছাড় না দিলেও ঋণখেলাপিদের জন্য সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই অনেকটা উদার নীতি দেখাতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারেও। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে খেলাপি গ্রাহকদের ছাড় দিতে বিদ্যমান নীতিমালা পূর্ণ-পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দ্রুত এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা দেওয়া হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। কমিটিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) একজন প্রতিনিধি, সাবেক ব্যাংকার মামুন রশীদ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকীকে সদস্য সচিব হিসেবে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এ-সংক্রান্ত একটি কমিটি হয়েছে। কমিটি বিদ্যমান সার্কুলারগুলো রি-ভিজিট করবে। শিগগিরই এটি আনুষ্ঠানিকভাবে সবাইকে জানানো হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, তিনটি কার্যপরিধি সামনে রেখে এ কমিটি কাজ করবে। প্রথমত, ঋণ শ্রেণীকরণ, পুনঃতফসিল এবং সুদ মওকুফ পলিসি সবগুলো পুনঃপর্যালোচনা করা হবে। দ্বিতীয়ত, যেসব গ্রাহক প্রকৃত অর্থেই সমস্যাগ্রস্ত কিন্তু পলিসিগত কারণে ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারছেন না, তাদের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হবে। তৃতীয়ত, ইচ্ছাকৃত খেলাপি নন তাদের আবেদনও নেওয়া হবে। পর্যালোচনা করে তাদেরও কিছু সুবিধা দেওয়া হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সমস্যাগ্রস্ত গ্রাহকদের কাছ থেকে আবেদন নেওয়া হবে। এরপর সবকিছু যাচাই-বাছাই করে কমিটির কাছে পাঠানো হবে। কমিটি যদি মনে করে ছাড় দেওয়া উচিত তাহলে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী ছাড় দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে ঋণ পুনঃতফসিল ও সুদ মওকুফসহ নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এখনও যদি একই ধরনের সুবিধা দেওয়া হয় সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। সুবিধা যদি দিতেই হয় তাহলে কেবল ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে যারা প্রকৃত অর্থে সমস্যাগ্রস্ত তাদেরকে দিতে হবে। বড় ব্যবসায়ীদের ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা গত ১৫ বছরে খেলাপি ঋণের অঙ্ক বাড়িয়েছে এবং সুদ মওকুফ সুবিধা নিয়ে পুনঃতফসিল করেছে।’
তবে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তারা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে হলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হবে। কিছু সুবিধা দিয়ে হলেও সরবরাহ গতিশীল করতে হবে। তবে করোনার সময় যেমন ঢালাও সুবিধা দেওয়া হয়েছিল এবার সেটি দেওয়া হচ্ছে না। যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি তারা কোনো সুবিধা পাবে না।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘চাওয়ামাত্রই সুবিধা দেওয়া হবে না। যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে কার সুবিধা দরকার আছে। যদি প্রকৃত অর্থেই সুবিধা পাওয়ার যোগ্য হয়, তাকে একটু সহায়তা করলে সে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তাহলেই কেবল ছাড় দেওয়া হবে।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘যদি প্রকৃত সমস্যাগ্রস্ত কিছু ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতেই হয় তাহলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের থেকে আদায় কার্যক্রম গতিশীল করতে হবে। কারণ সুবিধা পেয়ে ব্যবসায়ীরা টাকা ফেরত দিতে সময় নিলে ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়বে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের থেকে আদায় করে সে সংকট কাটাতে হবে। তা ছাড়া কোনো অবস্থাতেই যাতে প্রভাব খাটিয়ে কেউ সুবিধা না নিতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে কে সুবিধা পাওয়ার যোগ্য সেটি নির্ণয়ে ব্যাংকগুলোকে স্বাধীনতা দিতে হবে।’
এদিকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা জারি করার পরও হাতে-গোনা দু-একটি পদক্ষেপ ছাড়া অধিকাংশ ব্যাংক এটি পরিপালন করেনি। যদিও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতিমালা রয়েছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাওয়ার যোগ্য হবেন না, তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গাড়ি, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদির নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হবে। কোনো ফাইন্যান্স কোম্পানি বা ব্যাংক কোম্পানি কর্তৃক কোনো ঋণগ্রহীতাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হলে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতা কর্তৃক ঋণ পরিশোধপূর্বক ওই তালিকা হতে অব্যাহতি প্রাপ্তির পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ফাইন্যান্স কোম্পানি বা ব্যাংক কোম্পানির পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন না।
এ নীতি অনুসরণ না করার কারণেই নতুন উদ্যোগ নিতে হচ্ছে কি না জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল। তা ছাড়া ব্যাংকগুলো এ ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছে। তবে সময়ের ব্যবধানে এটি আরও গতিশীল হবে।’
নতুন ছাড় দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে এমন সিদ্ধান্ত আসতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকবে তারা কাকে সুবিধা দিলে তার ব্যবসা ঠিক থাকবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং টিম এটি নজরদারি করবে। তাদের ছাড়পত্র পেলেই সুবিধা পাওয়া যাবে।’
প্রসঙ্গত, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানাভাবে ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর শুরুতে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যেমন- ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে বলেছিল, কোনোভাবেই তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালাটিও ধরে রাখতে পারেনি। প্রভাবশালীদের তদবির ও চাপে পিছু হটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
প্রভাবশালী ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালে। সে সময় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ এক স্কিম হাতে নেওয়া হয়। তখন নিয়ম ছিল তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা যায় না। কিন্তু বেশিরভাগ প্রভাবশালী উদ্যোক্তাই তিনবার সুযোগটি নিয়েও খেলাপি হয়ে পড়েছিলেন। এরপরেই ঋণ পুনর্গঠন নামে নতুন এক সুবিধা দেওয়া হয়। এর আওতায় দেশের বড় ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তারপরও এসব গ্রুপের বেশিরভাগই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেনি।
২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আবার বদল হয়। ঋণ পরিশোধের সময় আরও তিন মাস বাড়ানো হয়। একই সময় ঋণ অবলোপন বা রাইট অফের ক্ষেত্রেও বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। তবে ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশের ইতিহাসে ঋণখেলাপিদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধাটি দেন। সে সময় ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ রাখা হয়। নতুন নিয়মে ঋণ পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় দেওয়া হয়, এর মধ্যে প্রথম এক বছর কোনো কিস্তি দিতে হয়নি। সেই সুযোগ নেওয়া বেশিরভাগই পরে খেলাপিতে পরিণত হয়েছেন। দেশের ব্যাংকগুলোতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।