Originally posted in যুগান্তর on 2 June 2023
জটিল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ও ভূকৌশলগত পরিস্থিতি এবং জাতীয় অর্থনৈতিক অবস্থাসহ সব জায়গায়ই বর্তমানে টানাপড়েন চলছে। ফলে এসব জটিলতাকে স্বীকার করেই এবারের বাজেটকে বিবেচনা করতে হবে। এছাড়া এই বাজেট বর্তমান সরকারের ১৫ বছর মেয়াদের সর্বশেষ বাজেট। সে কারণে এবারের বাজেটে বিগত দিনের অর্জনের কথা থাকবে, এটা আমাদের প্রত্যাশায় ছিল।
তবে একই সঙ্গে প্রত্যাশা করেছিলাম, বর্তমান বাস্তবতা জনমানুষের জীবনে যে কষ্ট দিচ্ছে, সেটাকে সুরাহা করার জন্য সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ থাকবে। কিন্তু সেই পথনির্দেশ খুঁজে না পাওয়ায় কিছুটা হতাশ হয়েছি। এবার যে ধরনের রাজস্ব ও ব্যয় কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানেও ওই ধরনের সুচিন্তার প্রতিফলন দেখিনি। অর্থাৎ যে ধারাতে সাধারণভাবে আমাদের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়, সে রকমভাবেই বাড়ছে। এ বছরও পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে। এর মানে হলো আগামী অর্থবছরে বাড়তি আয়টুকু আসবে, সেগুলো ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র সবাই মিলেই দেবে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে বড় মনোযোগ দেখিনি। উপরন্তু, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দের পরিমাণ অনেক কমেছে।
অন্য দিকে সামষ্টিক অর্থনীতির কাঠামো খুব জোরদার নয়। জিডিপি এবং ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগসহ যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বর্তমানে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে, তা খুব দ্রুত কমবে বলে মনে হয় না। এই মূল্যস্ফীতি কমানোর পথরেখাও বাজেটে নেই।
এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন জিনিসপত্রের দামে উৎসে কর কমানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু সেই সুযোগও কাজে লাগানো হয়নি। উলটো উৎসে করের সুযোগকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তেলে উৎসে কর কমিয়ে আবার শুল্ক দেওয়া হয়েছে, এতে বাজারে তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে। আর এবারের বাজেটে যে পদক্ষেপটি সবচেয়ে সমস্যার সৃষ্টি করবে, তা হলো করযোগ্য আয় না থাকলেও দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। এ ধরনের পদক্ষেপ অন্যায়। কারণ দেশে ইতোমধ্যে ন্যূনতম করের একটি বিধান রয়েছে। সেটি তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। সরকারি বিভিন্ন পরিষেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে এই কর দিতে হয়। ফলে যার করযোগ্য আয় নেই, তারও যদি দুই হাজার টাকা কর দিতে হয়, তাহলে করযোগ্য আয়ের ধারণাটা বাতিল করতে হবে। এ ছাড়াও সবাই কর দেয় না, এটিও মনে করার কারণ নেই। কারণ নিম্ন আয়ের মানুষও ভ্যাট থেকে শুরু করে অনেক ধরনের কর দিয়ে থাকে।
ফলে নির্বাচনের আগে এই দুই হাজার টাকার কর আরোপের পদক্ষেপ কোনো সুচিন্তিত বা বিবেচনাপ্রসূত কাজ হয়েছে বলে আমি মনে করি না।
এবারের বাজেটের আরেকটি আলোচিত বিষয় ছিল আইএমএফের শর্ত। এ ক্ষেত্রে আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছিল, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় তার সবগুলোরই নীতিগত স্বীকৃতি রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই শর্তের প্রতিফলনও দেখা গেছে। দুই হাজার টাকা কর নেওয়ার উদ্যোগ তার মধ্যে অন্যতম। এটি আইএমএফের শর্ত পালনে কর আদায় বাড়ানোর জন্য মরিয়া চেষ্টার অংশ।
আইএমএফকে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে যে প্রতি বছর জিডিপির ০.৫০ শতাংশ পর্যন্ত কর আদায় বাড়ানো হবে। কিন্তু রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতেও আইএমএফকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা যাবে না। এর পরও নীতিগভাবে সংস্থাটির শর্ত পালনে নানা ধরনের চেষ্টা বাজেট বক্তৃতায় রয়েছে।
এ ছাড়াও সাধারণভাবে এই বাজেটের ভেতর দিয়ে রাজস্বনীতির সঙ্গে মুদ্রানীতি, বাণিজ্যনীতি, ব্যাংকিং খাত ও বৈদেশিক লেনদেন খাতের সমন্বয় হয়েছে বলে মনে হয় না। আমরা বর্তমানে যে মধ্যমেয়াদি কাঠামোতে রয়েছি, তার লক্ষ্যমাত্রা বিশেষণ করলে দেখা যাবে সেখানে অনেক বৈপরীত্ব রয়েছে। এক কথায় বললে নির্বাচনি বছরে এই বাজেট নতুন কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে বলে হয় না।
লেখক: ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)