Originally posted in প্রথম আলো on 18 October 2023
অর্থনীতির বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি ও উত্তরণের উপায় নিয়ে প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া বর্তমান অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হবে। নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষে বড় ধরনের সংস্কার সম্ভব নয়। তবে নির্বাচনের পর সংস্কারের কৌশল কী হবে, তা এখনই ঠিক করতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ছিলেন চার অর্থনীতিবিদ, একজন সাবেক ব্যাংকার ও একজন ব্যবসায়ী।
আগে বলেছিলাম, অর্থনীতি এতিম হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তার পালক পিতা। এখন সেই পালক পিতাও নেই, অর্থনীতি পরিত্যক্ত সন্তান হয়ে গেছে। কেউ নজর দেয়নি। অর্থনীতির এই পরিস্থিতি এক দিনে হয়নি। এখানে সবাই উপসর্গের কথা বললেন, ফলাফলের কথা বললেন। কারণ বলেননি। ব্যাধির জায়গায় পৌঁছাতে হবে।
বর্তমানে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আছে, তারা ঐতিহাসিকভাবে মধ্যপন্থী সামাজিক গণতন্ত্রী দল। ২০০৮ সালের পর দলটি যখন দায়িত্ব নেয়, তখন রাজনৈতিক ঘোষণা দিয়েছিল। তাতে কল্যাণকর রাষ্ট্রের কথা বলেছে। সেখানে এমন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে সুযোগের সমতা থাকবে, সমতার সুযোগ থাকবে।
কিন্তু এখন শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, সামাজিকভাবেও বৈষম্যমূলক সমাজে পরিণত হয়েছে। কল্যাণকর আর্থসামাজিক দর্শন নিয়ে একটি দল ক্ষমতায় এসে কীভাবে এমন পরিণতিতে গেল। এটা কি অবধারিত ছিল? কোনো বিকল্প কি ছিল না?
সমাধানের পথ খুঁজতে হলে দেখতে হবে, এই পরিস্থিতিতে কেন এলাম, অর্থাৎ উপসর্গগুলো কী। প্রথমত, শুধু অফলপ্রসূ সংসদীয় ব্যবস্থার কারণে এমন হলো। সংসদে জনমানুষের কথা ধ্বনিত হলো না।
দ্বিতীয়ত, স্থানীয় জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে, এমন স্থানীয় সরকার বেশ দুর্বল এবং তা প্রতিনিধিত্ব করল না। তৃতীয়ত, উদ্যোক্তারা শ্রেণিস্বার্থ ভুলে গিয়ে রাজনৈতিক সংশ্লেষের মধ্যে ঢুকে গেলেন। চরম পরিণতি হিসেবে গোষ্ঠীস্বার্থ দেখছি। এর তিনটি চরিত্র দেখছি। এগুলো হলো প্রভূত অর্থ, প্রভূত রাজনৈতিক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। উদ্যোক্তারা আর শ্রেণিস্বার্থ দেখেননি। আরও দেখলাম, প্রশাসন পেশাদারি পরিত্যাগ করল, রাজনীতিতে যুক্ত হলো।
আমরা আরও দেখলাম, বিচারব্যবস্থা ও নজরদারি ব্যবস্থা দলীয়করণ হয়ে গেল। নীতি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেখলাম, সমন্বয়ের অভাব, সংযোগের অভাব ও নেতৃত্বের অভাব। আরও দেখলাম, বাজার অসম্ভবভাবে মেজাজি হয়ে গেল, বাজার দুর্বিনীত আচরণ করা শুরু করল। নাগরিক সমাজ ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। গণমাধ্যম সীমিত সত্য বলা শুরু করল, নির্বাচিত সত্য বলা শুরু করল। তথ্যের ঘাটতি ছিল, এরপর নতুন তথ্যের সৃষ্টি হলো। এতে আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি।
বর্তমান সরকারকে তিনটি পর্যায়ে দেখা যায়। প্রথম পর্যায়টি হলো ২০১৪ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে বিনিয়োগ, সংস্কারসহ যত নীতি উদ্যোগ নিয়েছে, সময়টি তাই উজ্জ্বলতম সময়। কোভিড পর্যন্ত একটি মন্দীভূত পরিস্থিতির মধ্যে গেছে। ২০১৮ সালের পর এই সংকটের উৎসমুখ পাওয়া গেছে। এ তিনটি সময়ের প্রতিটিতে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। এ ছাড়া কোভিডসহ বহির্বিশ্বের ইস্যু এসেছে।
আমি বলব, গণতান্ত্রিক জবাবদিহির অভাবের ক্রমবিকাশ আর অর্থনৈতিক সংস্কারের অভাবের ক্রমবিকাশ সমান্তরাল হয়ে গেছে। যত বেশি গণতান্ত্রিক জবাবদিহির অভাব হয়েছে, তত বেশি অর্থনৈতিক সংস্কারের অভাব হয়েছে। বর্তমান সরকারের উন্নয়নে বিপর্যয়ের জায়গাটি কোথায়? দর্শন, নাকি কৌশল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। দর্শনের ক্ষেত্রে খুব বেশি আপত্তি নেই।
কৌশল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে বর্শাফলক হিসেবে নেওয়া হলো। কিছু আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে নেওয়া হলো। এরপর দলীয় চিন্তা থেকে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলো। দলের ভেতর গণতন্ত্র নেই, বিতর্ক নেই, রাজনীতি নেই। দলটিও সেই ষাটের দশকের দল নয়।
এমন পরিস্থিতিতে আমরা স্থিতিশীলতায় যেতে পারব কি না? এভাবেই চললে আমরা কি সামনের দিকে যেতে পারব? যদি যেতে পারি, তবে কি তা ধরে রাখতে পারব? বাংলাদেশ এমন একটি ক্রান্তিকালে অবস্থান করছে, যেখানে উন্নয়নের উত্তরণ গণতান্ত্রিক উত্তরণের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।
আমরা প্রতিযোগিতামূলক জবাবদিহি একটা অর্থনীতি করব, যেটা দক্ষ হবে, প্রতিযোগিতামূলক হবে, অপচয় করবে না, অতিমূল্যায়িত প্রকল্প বানাবে না, বৈষম্য সৃষ্টি করবে না, বিভাজন করবে না—এগুলো সব চাইব। আর রাজনীতির ভেতরে থাকবে—ভোট দিতে পারব না, দলীয় প্রতিযোগিতা হবে না, দলের ভেতরে গণতন্ত্র থাকবে না, স্থানীয় সরকার ঠিকমতো কাজ করবে না, গণতান্ত্রিক উত্তরণ হবে না। এটা তো মৌলিক বিষয়। আপনি প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি অর্জন করতে পারবেন না।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণ, উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হওয়া—এসব করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক গুণগত পরিবর্তন দরকার। আর প্রাতিষ্ঠানিক গুণগত পরিবর্তনের জন্য প্রথম প্রতিষ্ঠান হলো রাজনীতি। এটিই বাকি সবকিছুর গন্তব্য ঠিক করবে।
সংকট উত্তরণে বড় দুই দলের কাছে নির্বাচনী অ্যাজেন্ডায় উত্তরণকালীন কৌশল দরকার। স্থিতিশীলতার জন্য এই অ্যাজেন্ডার মাধ্যমে রাজনৈতিক বৈধতা পায়, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করতে পারবে। কারণ, ওই সব প্রতিষ্ঠান নিজেরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি সিদ্ধান্ত নিতে পারে? তাহলে তো আইএমএফকে আনতে হয় না।