Originally posted in সময়ের আলো on 28 August 2022
সরকার দেশ চালাতে দেশ-বিদেশ থেকে ঋণ করছে। সে ঋণের বোঝা বাড়ছে দেশের জনগণের কাঁধে। বর্তমানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৯৫ হাজার ৬০০ টাকা। অর্থাৎ আজ যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার মাথায়ও সমপরিমাণ ঋণের দায় চাপবে। গত এক বছরে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৮৩০ টাকা। এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণের ওপর ঋণের দায় বৃদ্ধির চিত্র। একইভাবে ব্যক্তি ও পারিবারিকভাবেও ঋণের বোঝা বাড়ছে দেশের মানুষে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং স্বল্প আয়ের মানুষগুলো ক্রমেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।
চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে সব ধরনের খাদ্যপণ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবন ধারণ কঠিন করে তুলেছে। এর সঙ্গে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে যাতায়াত ভাড়া বৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির দাম বৃদ্ধি, বাড়িভাড়া, শিক্ষা ব্যয় ও চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধির ফলে মানুষ এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। মানুষ খাওয়া কমিয়েও এখন টিকতে পারছে না। কারণ যে হারে সব দিকের ব্যয় বেড়েছে, সে তুলনায় আয় বাড়েনি। ফলে ঋণনির্ভর জীবন হয়ে গেছে দেশের সাধারণ মানুষের। এ ছাড়া প্রতি মাসে ঋণ করায় ঋণের উৎসগুলোও সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এ কারণে আর কুলাতে না পেরে রাজধানী বা বড় শহরগুলোতে বসবাসরত সাধারণ পরিবারগুলোর অনেকেই গ্রামে পাড়ি জমাচ্ছেন।
এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি। এ মূল্যস্ফীতির কারণেই চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) দেশে নতুন দরিদ্র হয়েছে ২১ লাখ মানুষ।
এ তথ্য জানিয়ে ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ‘মহামারি করোনাকালে দেশের সাধারণ মানুষের আয় কমে গিয়েছিল ব্যাপকহারে। এ জন্য করোনায় দেশের নতুন দরিদ্র হয়েছিল ৩ কোটির বেশি মানুষ। এরপর শুরু হয় খাদ্যপণ্য ও সেবার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। আমরা চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের কষ্টের বিষয়গুলো নিয়ে একটি জরিপ করেছিলাম। তাতে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে আরও ২১ লাখ লোক। এরপর আরও তিন মাস পার হতে চলল। আমার মনে হয়, এ তিন মাসে মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নতুন দরিদ্র হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা আবারও জরিপ করব। বছর শেষে হয়তো আবারও নতুন দরিদ্র বৃদ্ধির সংখ্যা জানানো যাবে। সুতরাং করোনা ও মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা এখন সাড়ে ৩ কোটির ওপরে হবে।’
মিজানুর রহমান এক মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তাব্যক্তি। থাকেন রাজধানীর কল্যাণপুর নতুন বাজার এলাকায়। ৩০ হাজার টাকার বেতনে চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তারা স্বামী-স্ত্রী, তিন সন্তান ও বৃদ্ধা মাসহ ৬ জনের সংসার চালাতে হয় এ আয়ে। কিন্তু সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন আর কুলাচ্ছে না বেতনের টাকায়।
তাহলে কীভাবে চলছেন, জানতে চাইলে সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ‘যে বেতন পাই তা দিয়ে ঘর ভাড়া ও তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ দিয়ে আর তেমন কিছু থাকে না। কোনো রকমে টেনেটুনে, ধার-দেনা করে সংসারের খরচ মেটাই। কিন্তু আর কুলাতে পারছি না। দুই মাস আগে আমার আম্মা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। টাকার অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারিনি। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম, তিনি বলেছেন, মায়ের পেটে টিউমার আছে, অপারেশন করতে হবে। ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মতো খরচ হবে, কিন্তু টাকার অভাবে মায়ের অপারেশন করাতে পারছি না। ওষুধ খাইয়ে দাবিয়ে রাখা হচ্ছে। সংসারের খরচই মেটাতে পারছি না, এখন ১ লাখ টাকা কোথায় পাব। কিন্তু এভাবে আর কত দিন পারব জানি না। গত তিন মাস বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সংসার চালাতে হয়েছে। এখন আর তারাও ধার দিতে চাচ্ছে না। কারণ তাদেরও প্রায় একই অবস্থা। এ ছাড়া আগের ঋণ শোধ করতে না পারায় নতুন করে আর কেউ ঋণ দিচ্ছে না।’
রাজধানীর মিরপুর রূপনগর এলাকার গার্মেন্টস শ্রমিক শেফালী বেগমের কষ্টের মাত্রাটা আরও বেশি। মাসের বেতন ১২ হাজার টাকায় খেয়ে-না খেয়ে কোনোরকমে চলত ৫ জনের সংসার। টিনশেডের দুই রুমের ঘর ভাড়াতেই চলে যায় বেতনের অর্ধেক। বাকি ৬ হাজার টাকায় মাসের দশ দিনও যায় না এখন। ফলে স্থানীয় সমবায় সমিতি থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন গত মাসে। সে টাকায় তিন বেলার আহার জোটাতেই শেষ। এ মাস থেকে ঋণের কিস্তি নেওয়া শুরু হয়েছে, কিন্তু এখনও দিতে পারেননি তিনি। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী অসুস্থ, তিন সন্তানের বড় দু’জন স্কুলে পড়ে। বেতন দিতে না পারায় তিন মাস ধরে স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া এখন তিন বেলার বদলে দুই বেলা খাবার খাচ্ছি আমরা। সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তায় আছি ঋণের টাকা শোধ করা নিয়ে। সব মিলিয়ে আমরা ভালো নেই। আমাদের কষ্টও দেখারও কেউ নেই।’
দেশের সাধারণ মানুষের এ দুরাবস্থা কেন এবং এ সঙ্কট থেকে রেহাই পাওয়ার কি কোনো উপায় নেই? এ প্রশ্নের জবাবে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষের দুরাবস্থা বৃদ্ধির জন্য সরকারের নীতি-কৌশল বেশি দায়ী। কারণ সরকারের নীতি-কৌশলগুলো গরিববান্ধব না হয়ে ধনীবান্ধব হচ্ছে। যেমন, ভোজ্য তেল, চাল, ডিম বা যেকোনো ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে যখন দেওয়া হয়, তখন সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। একটি বারও ভাবা হয় না সাধারণ মানুষের কথা। এভাবেই গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে, ধনীর সম্পদ ফুলে-ফেঁপে আরও বড় হচ্ছে।’
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘এই কঠিন সময়ে যারা দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল, সঞ্চয় বলতে কিছু নেই-তাদের দুর্দশাটা বেশি। প্রতিদিন যেভাবে পণ্যমূল্য ও সেবা মূল্য বাড়ছে সে অনুযায়ী তো আয় বাড়ছে না। সুতরাং আয়-ব্যয়ে বিশাল একটি ঘাটতি থাকছে। এ ঘাটতি মেটাতে হয়তো কখনও ধার-দেনা করছেন কিংবা কখনও বাড়তি শ্রম দিয়ে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। সুতরাং ধারাবাহিক সঙ্কটের কারণে আয়ের উৎসগুলো শেষ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এই শ্রেণির মানুষগুলো খাওয়া কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এতে এসব পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। তা ছাড়া একসময় মধ্যবিত্ত অনেক পরিবার দরিদ্রদের তালিকায় নাম লেখাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এসডিজির অনেকগুলো লক্ষ্য পূরণ কঠিন হয়ে পড়বে।’
এনজিওর ঋণের দিকে বেশি ঝুঁকছে মানুষ : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যও বলছে, সাধারণ মানুষ ক্রমেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে তারা এনজিওর ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে বেশি। সম্প্রতি বিবিএস এক জরিপ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়, নগরের ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৩০ শতাংশ ঋণ করেন এনজিও থেকে, যেখানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় মাত্র শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ মানুষ।
ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে এনজিওর পর বেশি হাত পাতছে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর কাছে। এদের কাছ থেকে ১২ দশমিক ৬৯ শতাংশ মানুষ ঋণ নেন। অন্যদিকে সঞ্চয়ের জন্য ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ মানুষ এনজিওতে টাকা রাখেন। আর ব্যাংকে টাকা রাখেন মাত্র ৩৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৭ দশমিক শূন্য ৮, কর্মদাতা থেকে ১ দশমিক ২৫, মহাজনের কাছ থেকে ৩ দশমিক শূন্য ৪ এবং সমবায় সমিতি থেকে ১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ নগরবাসী ঋণ নেন।