Originally posted in প্রথম আলো on 4 August 2022
জ্বালানি খাতে সরবরাহ–সংকট একটা মধ্যমেয়াদি চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিশ্বে আবির্ভূত হয়েছে। শিগগিরই উল্লেখযোগ্য হারে জ্বালানির দাম কমার সুযোগ কম।
দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে জ্বালানিসংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ। করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে জ্বালানি চাহিদা বৃদ্ধি এবং ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপ ও অন্যান্য দেশের জ্বালানি–বাণিজ্য বন্ধ থাকায় আমদানিনির্ভর দেশগুলো এ সংকটের শিকার। বড় বিপাকে পড়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। বাংলাদেশও এ পরিস্থিতির বাইরে নয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর উচ্চ মূল্যে জ্বালানি কেনার সক্ষমতা সীমিত, যা অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশকে জ্বালানি সাশ্রয়, বিকল্প অনুসন্ধান ও সম্ভাব্য বিকল্প ব্যবহারে বাধ্য করছে। উন্নত দেশগুলোও জ্বালানি সাশ্রয়ে উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে এসব উদ্যোগ এখন পর্যন্ত জ্বালানিসংকটের কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান দিচ্ছে না।
এর অর্থ দাঁড়ায় জ্বালানি খাতে সরবরাহ–সংকট একটা মধ্যমেয়াদি চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিশ্বে আবির্ভূত হয়েছে। বৈশ্বিক জ্বালানিবাজারে শিগগিরই উল্লেখযোগ্য হারে দাম কমার সুযোগ কম। ফলে আগামী বছরাধিক কাল তুলনামূলকভাবে উচ্চ মূল্যে জ্বালানি আমদানির জন্য দেশগুলোর প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ, যা জ্বালানি আমদানি বা বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার কমাতে পারে—এমন পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বর্তমান সংকটকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প বা সহযোগী জ্বালানি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে উন্নত ও উন্নয়নশীল—উভয় প্রকার দেশই এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণে সুফল পেতে পারে। বর্তমান সংকটকালে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির সুবিধা শুধু পরিবেশদূষণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে না, বরং তা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটা বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে প্রমাণিত।
বর্তমান বৈশ্বিক জ্বালানিসংকট কি শিগগিরই মিটবে? উত্তর, সম্ভবত না। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ অবস্থানের ব্যাপক পরিবর্তন না হলে রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহ সীমিত আকারে অবশিষ্ট বিশ্বে অব্যাহত থাকবে। অন্যভাবে বললে, রাশিয়া তার ইউক্রেন নীতি থেকে বড় ছাড় না দিলে ইউরোপ ও আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় বড় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম। উভয় পক্ষই এখনো ব্যাপক ছাড় দেওয়ার অবস্থানে নেই, সে রকম ইঙ্গিত পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ইউরোপীয় দেশগুলো সামনে শীতকাল মাথায় রেখে ১৫ শতাংশ জ্বালানি কম ব্যবহারের উদ্যোগ নিচ্ছে। বিকল্প উৎস (যেমন আফ্রিকা) থেকে জ্বালানি আমদানির আলোচনা শুরু হয়েছে। বর্ধিত পরিমাণে জ্বালানি মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেনার কূটনৈতিক উদ্যোগ শুরু হয়েছে এবং জ্বালানি মজুত বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমিয়ে আনার আন্তর্জাতিক ঘোষণা থেকে সীমিত পরিসরে সরে আসার ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা অব্যাহত রাখা, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো ইত্যাদি।
এসব উদ্যোগে সীমিত আকারে জ্বালানিঘাটতি মিটবে। তবে তারপরও বড় ঘাটতি আগামী দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে বলে মনে হয়। জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক এখনো বড় আকারে তেল উৎপাদন বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়নি। ফলে জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা আগামী দিনগুলোয়ও অব্যাহত থাকতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বৈশ্বিক জ্বালানিবাজার নিকট ভবিষ্যতে করোনা-পূর্ব সময়কালে ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যদিও জ্বালানির দাম ধীরে ধীরে কমার সম্ভাবনা রয়েছে, তারপরও ২০২৩ সাল নাগাদ অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রতি ব্যারেল ৯২ মার্কিন ডলার, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্রতি এমএমবিটিইউ বা মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট ১৪ ডলার (জাপান), গ্যাস প্রতি এমএমবিটিইউ (ইউরোপ) ২৫ ডলার এবং কয়লা প্রতি মেট্রিক টন ১৭০ ডলারে থাকবে। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো আগামী দিনেও উচ্চ মূল্যে জ্বালানি কেনার চাপে থাকবে। অবশ্য এটাও মনে রাখা দরকার, বিশ্ববাজার সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না।
জ্বালানি কেনার জন্য প্রয়োজনীয় ডলারের মজুত থাকার বিষয়টি শুধু জ্বালানির আমদানি মূল্যের ওপর নির্ভর করবে না। এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে রপ্তানি কতটা বাড়বে, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কতটা আসবে, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক ঋণ কতটা পাওয়া যাবে, অন্যান্য পণ্যের আমদানি ব্যয় কেমন থাকবে, টাকা পাচার সীমিত থাকবে কি না—ইত্যাদির ওপর। মোট কথা, জ্বালানি খাতের সংকটটি মধ্য মেয়াদে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে থাকছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তাদের উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সরকার জ্বালানিসংকট মোকাবিলায় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন চলছে। যেমন জ্বালানি ব্যবহার সীমিত করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ খাতে লোডশেডিং, পরিবহন খাতে জ্বালানি সরবরাহ কমাতে উদ্যোগ গ্রহণ, বর্ধিত মূল্যে আপাতত এলএনজি না কেনা এবং পুরোনো গ্যাসকূপের অব্যবহৃত গ্যাস উত্তোলনে আংশিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ আগামী ৬ থেকে ১২ মাস অব্যাহত রাখার প্রয়োজন পড়বে। পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে কী পরিমাণ জ্বালানি সাশ্রয় হচ্ছে, তা নিয়মিত জনগণকে জানানো প্রয়োজন।
মনে রাখা দরকার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারের বাৎসরিক যে চক্র, তাতে শীতকালে বিদ্যুতের ব্যবহার কমে আসবে। তবে জ্বালানির ব্যবহার না–ও কমতে পারে। কেননা তখন কৃষিক্ষেত্রে সেচের জন্য বাড়তি জ্বালানির প্রয়োজন হবে। সেই চাহিদা এখন নেই।
সার্বিকভাবে জ্বালানিসংকটে কার্যকর মধ্যমেয়াদি উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন, যা একদিকে জ্বালানি সরবরাহ বাড়াবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাবে এবং সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ নিশ্চিত করবে।
যা করা যায়
দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো ব্যবহার করে, বিশেষত পুরোনো ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। বলা হয়ে থাকে, পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উত্তোলনের উদ্যোগ নিলে এক বছরের মধ্যেই গ্যাসপ্রাপ্তি শুরু হতে পারে। এই পুরোনো ক্ষেত্রগুলোয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস সঞ্চিত রয়েছে, যা উত্তোলনযোগ্য। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ত্রিমাত্রিক জরিপ সম্পন্ন করা জরুরি। এ জরিপের ফলাফল ইতিবাচক হলে ভবিষ্যতে গ্যাস উত্তোলনে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সহজ হবে।
দীর্ঘ মেয়াদে এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বা জ্বালানি হিসেবে এলএনজি সরবরাহ সীমিত রাখাও জরুরি। দেশে এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ ও আমদানি করে গ্যাস সরবরাহে অতি উৎসাহী একটি পক্ষ কাজ করে, যারা সরকারের ভেতর ও বাইরে রয়েছে। এদের কার্যক্রম সীমিত রাখা জরুরি। বর্তমান অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং ভবিষ্যতে জ্বালানিতে বৈচিত্র্যায়ণের জন্য এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সীমিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রস্তুতি পর্যায়ে থাকা ‘সমন্বিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানিব্যবস্থা নীতি’ যেন কোনোভাবেই এলএনজিভিত্তিক জ্বালানি ও বিদ্যুৎকাঠামোকে প্রাধান্য দিয়ে প্রস্তুত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার
আশার কথা, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে সবাই ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য জ্বালানির গুরুত্ব উপলব্ধি করছেন। তবে এ ক্ষেত্রে এখনো বাস্তবানুগ উদ্যোগ গ্রহণ কম হচ্ছে। যেহেতু নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন স্বল্প সময়ে করা সম্ভব, সে ক্ষেত্রে গ্রিডভিত্তিক এবং অফ-গ্রিডভিত্তিক জ্বালানি উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। সৌরবিদ্যুৎ এবং বায়ুবিদ্যুৎভিত্তিক প্রকল্প বৈদেশিক ঋণের বা বৈদেশিক বিনিয়োগের আওতায় বাস্তবায়ন শুরু করা জরুরি। বাজেট সহায়তা হিসেবে বিশ্বব্যাংক থেকে সরকার ১০০ কোটি ডলার ঋণসহায়তা চেয়েছে, তার আওতায় নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। পাশাপাশি জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যেমন ডিজেলচালিত, গ্যাসভিত্তিক অথবা এলএনজিনির্ভর, যাদের দক্ষতার মাত্রা খুব কম ও ব্যয়বহুল এবং কুইক রেন্টালের আওতায় স্থাপিত হয়েছে, এমন বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হলে শুধু জ্বালানি সাশ্রয় হবে, তা নয়, একই সঙ্গে সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া থেকে মুক্তি পেতে পারে। এর ফলে সরকারের ভর্তুকিজনিত চাপও কমবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে সরকার যে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ চাচ্ছে, তা পেতে হলে শর্ত মানতে হবে। আইএমএফ সাধারণ ভর্তুকি কমানোর শর্ত দিয়ে থাকে। সরকার আইএমএফের ভর্তুকি সমন্বয়ের শর্তের বিষয়টি বিদ্যুৎ খাতের জন্য উপযুক্তভাবে ব্যবহার করতে পারে। ভর্তুকি সমন্বয়ের বিষয়টি হতে পারে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অপসারণ, ব্যয়বহুল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্র কম ব্যবহার ও ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার শর্ত অবলোপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে। আইএমএফের ঋণ একই সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অর্থায়নের তহবিলেরও উৎস হতে পারে।
এসব উদ্যোগ একদিকে জ্বালানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াবে, অন্যদিকে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ নিশ্চিত করবে এবং ডলার ব্যবহারের চাপ কমাবে। এ ক্ষেত্রে নির্মোহভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপযোগিতা এবং বর্তমান সংকটকালে এর গুরুত্ব এবং ভবিষ্যৎ জ্বালানি মিশ্রণে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
লেখক: গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)