Published in দৈনিক ইনকিলাব on Saturday, 17 March 2018
বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন হবে
হাসান সোহেল
জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশের লাভ-লোকসানের হিসাব নিয়ে শুরু হয়েছে নানা বিশ্লেষণ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ত্রিবার্ষিক বৈঠকে বসেছে কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। গত ১২ মার্চ থেকে শুরু হওয়া এই বৈঠক আজ ১৬ মার্চ শেষ হবে। এই বৈঠকেই স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাংলাদেশসহ আরও ১৫টি দেশ রয়েছে এই তালিকায়। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ নেপাল ও ভুটান রয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের জন্য নির্ধারিত তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় অবস্থান নিশ্চিত করেছে। ফলে এ তালিকা থেকে উত্তরণের সুপারিশের জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত। তবে তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বেশকিছু সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। তবে রফতানি বাণিজ্যের জন্য সহায়ক হবে বাংলাদেশের। পাশাপাশি তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। সারা বিশ্বে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে। বৈদেশিক ঋণ প্রাপ্তিও সহজ হবে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের লাভ বা ক্ষতি কতটুকু হবে, সে বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত হিসাব নেই সরকারের কাছে।
জানা যায়, এলডিসি থেকে উত্তরণের লাভ-ক্ষতির হিসাব এখনও কষা হয়নি। ফলে এ থেকে বাংলাদেশ কী কী পাবে, আর কী কী হারাবে তার নির্দিষ্ট হিসাব কারও কাছে নেই। এ হিসাব কষতে গত বছরের ডিসেম্বরে বিভিন্ন ধরনের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে সরকারি দফতরগুলোতে চিঠি দিয়েছিল এলডিসি বিষয়ে সরকারের ফোকাল পয়েন্টের দায়িত্বে থাকা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলো থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুবিধাসহ নমনীয় হারে উন্নয়ন সহায়তা পেয়ে আসছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের অনুকূলে এসব বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহায়তা পর্যায়ক্রমে হ্রাস পাবে এবং বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে সম্ভাব্য প্রতিকূলতা ও উত্তরণের ক্রান্তিকাল যাতে মসৃণ হয়, সেজন্য এখন থেকে কার্যক্ষেত্রে নিবিড় সম্পৃক্ততা বজায় রাখা জরুরি। এ বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নিজস্ব কাঠামোর আওতায় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে। এলডিসি-বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সদস্য-সচিব মনোয়ার আহমেদ বলেন, চলতি মাসে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করা হলেও চূড়ান্তভাবে এলডিসির সুবিধাগুলো বিলুপ্ত হবে ২০২৭ সালের পরে। ফলে আমাদের মূল্যায়নের সময় আছে অনেক। সাধারণত প্রথম সুপারিশের পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে এটি করা হয়। আমরা আরও আগেই কস্ট-বেনিফিট অ্যানালিসিসটা করতে পারব। এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা শুরু হয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের বিষয়ে জানতে চাইলে এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে সরাসরি কোনো লাভ পাওয়া যাবে না। তবে উত্তরণের পর বাংলাদেশ সম্পর্কে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। বিষয়টি নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য সহায়ক হতে পারে। তবে এ উত্তরণও ২০২৪ সালের আগে হবে না। কারণ এবার প্রাথমিক সুপারিশ উত্থাপিত হবে, যা চূড়ান্ত হবে আরও ছয় বছর পর।
দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানাচ্ছে, সিডিপির বৈঠকে বাংলাদেশের ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ এই তিন বছরের সূচকের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হবে। একটি দেশকে উন্নয়নশীল তালিকাভুক্ত হতে মানবসম্পদ উন্নয়নে ১০০ এর মধ্যে ৬৬ পয়েন্ট থাকতে হয়। বাংলাদেশের রয়েছে ৬৮ দশমিক সাত পয়েন্ট। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতায় ৩২ পয়েন্টের নিচে থাকতে হয়। বাংলাদেশ রয়েছে ২৫ দশমিক ১১ পয়েন্টে। আর জাতীয় মাথাপিছু আয় (জিএনআই) এক হাজার ২৪২ মার্কিন ডলার হতে হয়। বাংলাদেশ এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে এক হাজার ৬১০ ডলারে।
বাংলাদেশকে অবশ্য সূচকের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে ২০২১ সাল পর্যন্ত। ২০২২ সালের শেষের দিকে জাতিসংঘের নির্ধারিত নিয়মে সূচকের তথ্যগুলোর সমন্বয়ে চূড়ান্ত হিসাব তৈরি করা হবে। ২০২৪ সালের মার্চে সিডিপির নতুন বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন হলে তা পাঠানো হবে ইকোসোকে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চ‚ড়ান্ত করে জাতিসংঘে প্রতিবেদন পাঠাবে ইকোসোক। সাধারণ অধিবেশনে তা স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে। এসব প্রক্রিয়ায় মোট ছয় বছর লাগবে। সে পর্যন্ত বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
কী হারাবে বাংলাদেশ
এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বাণিজ্য, শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা, উন্নয়ন অর্থায়ন, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও কৌশলগত সহায়তা পেয়ে আসছে। এছাড়া ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে স্বল্পোন্নত দেশগুলো পেটেন্ট লাইসেন্স ছাড়াই ওষুধ উৎপাদন করতে পারে। ফলে বাংলাদেশে বর্তমানে এই খাতে যেসব দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী রয়েছে তারা এ সুবিধা পেয়ে আসছে। জলবায়ু তহবিল থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলো সুবিধা পেয়ে আসছে। এছাড়া আগামীতে সেবাখাতে বেশকিছু সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। ২০২৪ সালের পর থেকে এসব সুবিধা আর পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশের কী করণীয়?
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় কী এমন প্রশ্নের উত্তরে সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, এই উত্তরণের মধ্য দিয়েই সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এখনও বাংলাদেশের তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আমাদের অর্থনীতি এখনো পুরোপুরি শিল্পায়িত হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি আমাদের পরিস্থিতিনির্ভর অর্থনীতি থেকে উৎপাদনশীলতানির্ভর অর্থনীতির দিকে যেতে হবে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জনের জন্য আমাদের প্রযুক্তির আধুনিকায়ন, দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
সেই সঙ্গে অবকাঠামোসহ ব্যবসায় পরিবেশ সক্ষমতা, বন্দর সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। যাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা না পেলেও পণ্যের দাম ঠিক রেখে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় রাখা যায়। এছাড়া পরিবর্তিত বাস্তবতায় বিশ্ববাণিজ্যে অংশগ্রহণের জন্য যুগোপযোগী বাণিজ্য নীতি প্রণয়ন এবং যেসব দেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেছে তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির সক্ষমতা বাড়াতে এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এর আগে যেসব দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে তারা ছোট ছোট দেশ। তাদের জনসংখ্যা খুবই কম। ওই সময় তাদের প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক বিনিয়োগে পতন ঘটেছে, রেমিট্যান্সও কমেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে বের হচ্ছে তখন বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি অনুকূলে নয়। এজন্য বাংলাদেশকে এলডিসি উত্তরণকালীন টেকসই অর্থনীতি ধরে রাখতে উত্তরণকালীন কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিশ্ববাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে উৎপাদনও বাড়াতে হবে এবং একই পণ্যে নির্ভর না করে পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। তিনি বলেন, এলডিসি থেকে বের হলে রেয়াতি সুদের সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ। এজন্য নতুন উচ্চ সুদ মোকাবিলায় করণীয় ঠিক করতে হবে। রফতানি বহুমুখীকরণ, শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়ন, শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা ধরে রাখাসংক্রান্ত কৌশল সরকারকে নিতে হবে। এছাড়া দেশের ভেতরে গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতা ঐক্য এবং সুশাসন ধরে রাখতে না পারলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুফল পাবে না। তিনি বলেন, এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের আঘাত পড়বে। এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনায় বাজারসুবিধা হারাবে বাংলাদেশ।